সুজাতাটা মহা মিথ্যুক। রং না চড়িয়ে একটাও কথা বলতে পারে না। ওর কাছ থেকে কোনো ঘটনা শুনে মিনিমাম থার্টি পার্সেন্ট ডিকাউন্ট করতেই হবে।
-কি রে কাল আসিস নি কেন?
-ঐ তো মামাতো দাদা এসেছে। ইংল্যান্ডে থাকে।
সহেলি একচোট হেসে নিয়ে বলে উঠল
-ইংল্যান্ড কি পাশকুড়ার পরের স্টপ নাকি রে?
সুজাতার লাজলজ্জা নেই। একেবারে বেশরম। ঠিক পরের দিন সঞ্জনাকে গ্রে হন্ডা সিটিতে উঠতে দেখে বেমালুম বলে উঠল -আমাদের না একটা বিএমডাবলু আর একটা ইয়েলো অডি গাড়ি আছে।
ওর কথা শুনে আমি সোজা পেছন ফিরে গাছের পাতা গুনতে লাগলাম।
- দু দুটো এক্সপেন্সিভ কার থাকতেও এই ভাঙ্গা বাসে যাতায়াত করিস কেন রে? কমলা রংয়ের কাঠি আইসক্রিম চুষে খেতে খেতেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেয় কুসুম। সুজাতা মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। সে তখন মন দিয়ে স্কার্টের প্লিট ঠিক করছে।
সুজাতা জৈসওয়াল অবাঙালি হলেও পাক্কা ক্যালকেশিয়ান। মাঝে মাঝে খুব উত্তেজিত হলে দুয়েকটা হিন্দি বললেও ওর বাংলা প্রায় প্রায় নিখুঁত বলা চলে । ওদের গ্রামের বাড়িতে অলিম্পিক সাইজের সুইমিং পুল, উঠোনে আপেল-নাশপাতির গাছ, ফ্ল্যাটের বারান্দায় উড়ে অাসে ময়ুর এই জাতীয় গুল্প শুনতে অনেকেরই বেশ মজা লাগে। স্কুলের অনেকেই ওর এই অভ্যাসের সাথে পরিচিত।
সেদিন ইতিহাসের ক্লাসে দীপাবলী মিস পড়াতে গিয়ে ম্যানুসক্রিপট এর প্রসঙ্গ তুলতেই ফার্স্ট গার্ল জুবেদার সাথে সুজাতার হাত আকাশপানে উঠে গেল। আমরা কজন মনে প্রাণে চাইছি মিস যেন সুজাতাকেই দাঁড় করান। ভর দুপুরবেলা যখন সবার ঢুলু-ঢুলু চোখ, তখন মন আলোআঁধারি ট্যানেল বেয়ে কোন অজানার উদ্দেশ্যে ধেয়ে যায় । দীপা মিসের বোরিং ক্লাস করতে একফোঁটা ইচ্ছে করে না। সুজাতার ইন্টারেস্টিং গল্প ঘুম কে ছক্কা হাঁকানোর স্টাইলে তাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। সেদিন কি জানি কি ঘটল যে 'উপরালা' আমাদের আর্তি যথাস্থানে পৌঁছে দিল।
এখন এই 'উপরালা' শব্দটাও ঐ সুজাতার অবদান। ওর কথা অবিশ্বাস করলেই মুখটা ঘুরিয়ে বলে উঠত - উপরালা জানেন সে কখুনো মিছা কথা বোলে না।
তাছাড়া বুড়িদের মতন যখন তখন হাঁ, উপরালা দেখছে, দ্য গিল্টি শ্যাল বি পানিশড , বলে আমাদের কনশাশ কে সাবধান করে।
কনভেন্ট স্কুলের বাইবেল ক্লাস, প্রেয়ারে জিসাসের হিম, বাড়ির বিপত্তারিণী, সন্তোষীমা, বাবা লোকনাথ সব মিলিয়ে আমাদের ঠাকুরের কনসেপ্ট ভারী গোলমেলে । প্রণাম করতে গিয়ে আমরা ভুল করে ক্রস আঁকি , আবার স্কুলের চ্যাপেলে যিশু কোলে মাদার মেরীর সামনে আরতি কায়দায় মোমবাতি ঘোরাই। আমাদের ক্লাসের জুবেদা যেমন মোটা তেমনি প্রবল মোটাসোটা ব্যক্তিত্ব। সে আবার মাঝে মাঝেই আমাদের কুরআনের ক্লাস নেয়। গোল থলথলে মুখে আমাদের দিকে তাকিয়ে নামাজ পড়ার কথা বললে সবাই মিলে নামাজ পড়া শিখতে রাজি হয়ে যাই। সে গল্প অন্য দিন করলে হবে।
দীপা মিস ক্লাস টপার জুবেদাকে অগ্রাহ্য করে সুজাতার দিকে আঙুল তুলেছেন দেখেই ঋতিকার কনুই এর খোঁচা খেলাম।
- মিস উই হ্যাভ এ ম্যানুসক্রিপট ইন আর হাউস। খুব পুরোনো তুলসীদাস টাইমের পোথী।
লাও সামলাও এবার গুল্পের ঠেলা। ওর পুঁথি কে পোথী বলাতে ক্লাস জুড়ে হাসির হর্রা উঠল। সুজাতার সব কিছুই এক্সট্রিম। ঝিমোতে থাকা পবিত্রা, বন্দিতা, শর্মিলারা হঠাৎই জেগে উঠে বিজবিজ করে গল্প জুড়ে দিল। ভালোমানুষ দীপা ম্যাম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, হতাশ মুখে বাঁ হাত তুলে সময় দেখতে দেখতে মৃদু হুংকার দিলেন- ক্লাস কীপ কোআয়েট।
সিংহীর গর্জন হলে ক্লাস শুনত, বিড়ালের মিনমিনে মিঁয়াউ কে ভারী কেয়ার করে তারা। বিজবিজে শব্দ বাড়তে বাড়তে করিডোর অব্দি পৌঁছে গেল। ম্যাম এক প্যারা পড়াতে না পড়াতেই ঘন্টা বেজে ক্লাস শেষ।
পরের দুটো ক্লাস আর্ট এন্ড ক্রাফ্ট। হাসাহাসি ঢেউ তখনো চলছে।
- কিরে তুলসীদাস তোর গ্রেট টু দি পাওয়ার এনেথ গ্র্যান্ড ফাদারকে গিফট দিয়েছিলেন বুঝি?
- রয়েল ফ্যামিলি!
- আরেএএ স্কলার ! এবার মজাটা শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। সুজাতা পড়াশোনায় খুব খারাপ। আর কে না জানে খোঁড়াকে কে খোঁড়া বলিও না।
পরদিন এসেম্বলির পর সুজাতা ব্যাগ থেকে একটা লাল শালুর মত কাপড়ে মোড়া একটা চৌকো জিনিস বার করে টিচারের টেবিলে রাখল। হাত জোড় করে ভক্তিভরে প্রণামের পর বুকে ক্রস এঁকে সুজাতা শালুটা খুলে ফেলল। গোটা ক্লাস হতভম্ব, টুঁ শব্দটি নেই। দু হাত দিয়ে ঝুরঝুরে হলুদ কাগজের পাতা তুলে সবাইকে দেখিয়ে সুজাতা বলল
- সি, দিস ইস এ ম্যানুসক্রিপট। অ ভেরি ওল্ড এন্ড ট্রেজারড পিস অফ্ আওয়ার ফ্যামিলি। পারিবারিক সম্পত্তি।
আমাদের মুখ বন্ধ। জুবেদা ফার্স্ট বেঞ্চ।
- ওয়াও! দিস লুকস রিয়েলি ওল্ড! কেয়ারফুল, পেপার ছিঁড়ে যাবে।
সুজাতার প্রতি সবার রেস্পেক্ট বেড়ে গেল। কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে থাকলেও ক্লাস প্রিফেক্ট জুবেদার দাবড়ানি খেয়ে আমরা কিছু করলাম না। লাস্ট পিরিয়ড স্যান্সকৃট মিসের জ্বর বলে তার বদলে দীপা মিস ক্লাসে ঢুকলেন।
আগের দিনের হইচই আবার ফিরে এল। আজকে সবার জোরালো গলা। মহার্ঘ ঐতিহাসিক জিনিস ক্লাসে হাজির। মিসকে দেখেই অবশ্য সুজাতার মুখ চুন। বাড়িতে জানতে পারলে ওর কপালে মার আছে।
পবিত্রা ফাঁক পেয়েই সবটা উগরে দিল। দীপা মিসের চোখ আক্ষরিক অর্থেই কপালে। সুজাতার বেঞ্চের কাছে এসে শালু মোড়া কাগজটা এক ঝলক দেখেই হেসে ফেললেন
- মাই চাইল্ড তোমার কল্পনা শক্তি ফ্যান্টাস্টিক। এগুলো অলমোস্ট সেভেন্টি ইয়ার আগের বাড়ির দলিল। দামী ঠিকই তবে তুলসীদাসের লেখা না । কেন এনেছো স্কুলে এসব?
সবাই সুজাতাকে নিয়ে হাসাহাসি করতে লাগল। ঈশ্বরই জানে ও কেন এমন করে। জুবেদা ওর ব্যাগ পাহারা দিয়ে বাসে তুলে দিল। এর পর গুড ফ্রাইডের চার দিন ছুটি। ইস্টার্ন মানডের পর মঙ্গলবার স্কুলে এঞ্জেলা মিসের ইংলিশ রাইটিং ক্লাস । আমরা সাধারণত একটা পিরিয়ড ডিসকাস করি আর পরের ক্লাসে লিখি। ডিসকার্সনে দেখা গেল প্রায় অর্ধেক ক্লাস মন্দারমনি, দীঘা, পুরী বেড়াতে গেছিল। ম্যাম ওটাই টপিক দিলেন। আমাদের মতন যারা কোথাও যাই নি তারা তো ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলাম।
হঠাৎই শুনি সুজাতা বলছে
- লাস্ট থার্সডে স্কুলের পর দাদাজির পিন্ড দিতে গয়াধাম গেলাম , সেখান থেকে গুড ফ্রাইডের দিন বিকেলে ত্রিভান্দ্রমে একটা চার্চে মোমবাতি জ্বেলে শনিবার বেথলেহামে জিসাসের কাছে প্রে করে , ফেরার পথে পাটনাতে নানার সাথে দেখা করে এসেছি। আর কে না জানে পাটনা গেলে পটনাসাহিব ইজ এ মাস্ট ভিজিট ?
ক্লাস শুদ্ধু সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল। এঞ্জেলা মিস্ ভ্যাবাচাকা!
বকবেন ,না কি বলবেন বুঝেই পাচ্ছেন না।
রিসেসে সবাই টিফিন কৌটো খুলে রেখেও হেসে কুটোপাটি ? ব্যাক বেঞ্চের পবিত্রা, সম্পূর্ণা ঘুরে ফিরে সবাইকে বলছে সুজাতা নাকি জিসাস এর মন্দির থেকে ওয়াইন আর রুটির প্রসাদ এনেছে। যথারীতি সুজাতার মুখে সরল হাসি। আবার এদিকে সুজাতার বেড়ানোর লিস্টে মসজিদ নাই বলে জুবেদার মুখ হাঁড়ি। বোঝো কান্ড!
এপ্রিলের শেষ হবার আগেই গরমে আমরা নাজেহাল। দিন গুনছি কবে মে মাস আসবে। আমাদের প্রিন্সিপাল সিস্টার জোসেফিনার আমলে আমাদের নিশ্বাস নেবার জো নাই। ছুটি আরম্ভ হবার আগের দিন ,আবার স্কুল খোলার দিন পঞ্চাশ নাম্বারের পরীক্ষা রেখে দিয়েছে। একটু যে রিল্যাক্সড থাকব তার উপায় নেই। ডাইনি বুড়ি একটা। গতবছর স্কুল জয়েন করেই দেখেছিল যে অনেকে ছুটি পড়ার আগেই বেড়াতে চলে যায়। তাই এবছর থেকে ইংরেজি পরীক্ষার পর ছুটি পড়বে আর স্কুল খুলেই অঙ্কের পেপার। বাঁশ আর কাকে বলে?
মিস্ কৃষ্ণা আমাদের অঙ্ক পড়ান। ভু ভারতে এমন খারাপ টিচার আছে কিনা সন্দেহ। পড়াতে তো মোট্টে পারে না তার ওপরে কি ভয়ানক বদমেজাজি। বাপরে বাপ। লাস্ট উইক থেকে ট্রিগনোমেট্রি ধরেছে।একদম বোঝাতে পারছে না । নিজেই ফর্মুলা ভুল লিখে মেলাতে না পেরে ঘেমে নেয়ে একাক্কার। উপালী অনেকক্ষণ ধরে উসখুস করছিল শেষে হাত তুলে বলেই ফেলল- মিস মিস থার্ড লাইনে না মাইনাস হবে না মিস।
চকের সাদা ধুলো লাগা আঙুল দিয়ে নাকের উপর ঝুলে আসা চশমাটা ঠিক করে কঠিন চোখে আমাদের দিকে তাকালেন। কৃষ্ণা মিসের কানের পাশ থেকে নাক অব্দি সাদা হয়ে গেছে। মিসের আবার শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে থাকার অভ্যাস । নীল ধনেখালি শাড়ির গায়ে চকের ফুল ফুটে উঠেছে। অঙ্কটা শেষ LHS = RHS লিখে মিস জোরে নিশ্বাস ফেলে আঁচল দিয়েই ঘাম মুছলেন ।অমনি ভেজা নীল টিপ ভুরুর মাঝ থেকে উঠে এক পাশে সরে গেল। এমনিতেই ইংরেজি পরীক্ষার পরে সবার মনটা বেজায় ফুরফুরে , কারণে অকারণে হাসি সোডার মতন ভসভসিয়ে উঠছে । তার মাঝে মিসের এহেন হেনস্থায় আমরা বেজায় উৎফুল্ল হয়ে উঠলাম। মিসের দৃষ্টি কিন্ত উপালীদের বেঞ্চের দিকে। উপালী মন দিয়ে অঙ্ক কসছিল,পাশে বসে থাকা রামবুদ্ধু সুজাতাটার মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল কিনা তা কে জানে । হঠাৎই মিস সুজাতাকে ডেকে বোর্ডে প্রবলেম সল্ভ করতে দিলেন। দু লাইন ভুলভাল কিছু লিখে বোকাটা দাঁড়িয়ে থাকল। ওর দোষ নেই , ঐ অবস্থায় পড়লে ক্লাসের অর্ধেকের বেশি মেয়ের একই হাল হত। ততক্ষণে সুজাতার বাঁ হাতে আঁকা মেহেন্দীর ডিজাইন মিসের চোখে পড়েছে। যেখানে বাঘের ভয়.. আমাদের কন্ভেন্ট স্কুলে হাতে মেহেন্দী লাগালে ডায়েরিতে নোট যায়। পেরেন্ট সিগনেচার, তুলকালাম কান্ড।
- এটা কি? স্কুলের নিয়ম জানো না?
- সরি মিস ,ছুটিতে গ্রামে যাব। কাজনের বিয়ে, তাই রেড স্কেচ পেন দিয়ে ট্রাই করেছি, আর করব না মিস।
বেচারি সুজাতার জন্য এই প্রথম আমাদের খারাপ লাগল।
- ব্রিং ইয়োর ডায়েরি ।
-আর করব না মিস। সরি।
- আনো ডায়েরি।
- প্লিজ মিস। সরি মিস। সুজাতার গলা কাতর।
- প্লিইজ মিস। সুজাতার গলা নকল করে মিস ডাস্টার দিয়ে বোর্ড পরিষ্কার করতে করতে ভেঙ্গিয়ে ভেঙ্গিয়ে বললেন
-পড়াশোনা লবডঙা চলল মেহেন্দী লাগিয়ে বিয়েবাড়ি। পাশ করবে তো নাকি লাস্ট টাইমের মত আবার থার্টি থ্রি। হুঁহ্ বাপের পয়সার শ্রাদ্ধ। পরের বছর টেন মনে আছে তো? বাই দ্য ওয়ে, হোয়াট ইজ ইয়োর এল্ডার সিস্টার ডুইং?
সুজাতার মাথা নেমে এল বুকের কাছে। আমরা যখন ফাইভে তখন ওর দিদি সুষমা ক্লাস টেনে। ঠিক বোর্ডের আগে ওর বিয়ে হয়ে যায়। পরীক্ষায় বসতে পারে নি। এই তো জানুয়ারি মাসে সুষমাদির দ্বিতীয় ছেলেটা হয়েছে।
- ওর বিয়ে না দিয়ে তোমারই বিয়ে হওয়া উচিত ছিল। তাও তো ওর পড়াশোনার মাথা ছিল। তোমার তো গোবর পোরা। হাতের ডাস্টার দিয়ে ওর মাথায় টোকা মেরে দাঁত খিঁচিয়ে, চেঁচিয়ে বললেন- গো ব্যাক টু ইয়োর বেঞ্চ।
এই বলার সাথেই সাথেই ক্লাস ওভারের বেল বেজে উঠল।
-এই ছুটিতে বেথলেহম না গিয়ে আর্কিমেডিসের কাছে অঙ্ক শিখে এস।
শব্দ করে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে মিস কৃষ্ণা ডান চোখের ওপরে নীল ফোঁটা নিয়ে মশমশিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
মিসের ক্লাস থেকে বেরোতে দেরি, গোটা ক্লাস হইহই করে হেসে উঠল। উপালী যে উপালী সেও শুদ্ধু হাসছে। প্রিফেক্ট জুবেদা হাততালি দিয়ে 'বেথলেহম-বেথলেহম' বলে বলে হাসতে লাগল।
- চিন্তা করিস না দাদা বলেছে মাথায় গোবর থাকা ভাল। গোবরে সার হয়।
ক্লাসের অন্য প্রান্ত থেকে শোনা গেল।
স্কুল ছুটির দিন বন্ধুদের ছেড়ে যেতে মন চায় না। আসন্ন বিচ্ছেদের কথা ভেবে সবার মন ভারাক্রান্ত । সবাই নিজের নিজের বেস্ট ফ্রেন্ড জড়িয়ে ধরে বিদায় জানায়।
-হ্যাপি হলিডেস। শঙ্কর কাকুর বাসের সবাই একসাথে চেঁচাই।
বাসকাকু সেদিন খুব ভালো। বকা ঝকা নাই, কড়া ডিসিপ্লিনের চোখরাঙ্গানি নাই ,বরং গেট থেকে বেরোবার আগে বড় ঝাঁকড়া আম গাছের তলায় দাঁড় করিয়ে হেল্পার কাকু সবার জন্য কাঁচা আম পেড়ে আনে। দীর্ঘ ছুটিতে কে কোথায় যাবে, কি করবে এর সাথে অঙ্ক পরীক্ষার কথাটাও মনের কোণে দপদপ করে।
-তুই অঙ্কের টিউশন নিস্ মালা?
- না রে। এবার নিতে হবে মনে হচ্ছে।
-কিছুই তো বুঝলাম না রে। মিস তো 'না বুঝলে মুখস্থ করে নিও ' বলেই খালাস। সুজাতার মুখটা চিন্তাকুল দেখাচ্ছিল।
ছুটিতে কিছু যে একটা করতে হবে এটা দুজনেই বুঝতেই পারছিলাম।
- আমায় হেল্প করবি মালা?
- এমা কেন করব না? তবে আমি উপালী, জুবেদাদের মতন গ্রেট স্টুডেন্ট নই।
সুজাতা জানলার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল- হা আমিও তো বুদ্ধু।।
- নো ওয়ারি, বোথ অফ আস উইল ফিগর ইট আউট। তুই গ্রাম থেকে ফেরত আয়।
তবে ছুটির একমাস দশ দিন কোথা দিয়ে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। প্রতিবারের মতন শেষ সপ্তাহে হোমওয়ার্ক , পড়া আরম্ভ হল। প্রত্যেক বছর নাকানি চোবানি খাই, তবু আমাদের চেতনা হয় না। সুজাতাও মনে হয় গ্রামে গিয়ে সব ভুলে গেল।
পঞ্চাশ মার্ক্সের অঙ্ক পরীক্ষার জন্য পড়তে গিয়ে জোসেফিনার ওপরে রাগ আরো বেড়ে যায়। - হে জিসাস, হে মাদার মেরী পরীক্ষাটা ক্যানসেল করে দিও প্লিইজ ,পরপর সাত দিন তোমার চ্যাপেলে ক্যান্ডেল জ্বালাবো।
প্রে করার এই কায়দা আমাদের ক্লাস সিক্সে ক্লাস টিচার সিস্টার স্টেলার । অল্পবয়সী আর হাসিখুশি নান স্টেলাকে দেখেই আমরা চ্যাপেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে মানত করতে শিখি। সেই সময় আমরা সবাই বড় হয়ে নান হব বলে ঠিক করেছিলাম। সেই বছর পুজোর পর সিস্টারকে আর দেখতে পাই নি। কানাঘুষো শুনেছিলাম সিস্টার নাকি পাশের বয়েজ স্কুলের ফাদার কে বিয়ে করে কনভেন্ট ছেড়ে পালিয়েছে।
যাই হোক নিষ্ঠুর 'উপরালা' আমাদের অনেক প্রার্থনার মত পরীক্ষা ক্যানসেল হবার প্রার্থনাও মঞ্জুর করলেন না। জুবেদা বলল আমরা নাকি তেমন মন দিয়ে চাইতেই পারি নি। সুজাতাটাও কি হোপলেস রে বাবা, ছুটির দিন কত কি বলল অথচ আজকে স্কুল খোলার দিনেই বাস মিস করল, গ্রামেই থেকে গেল নাকি?
এসেম্বলির পর উপালীর থেকে চেয়ে ফর্মুলা লেখা কাগজটাতে শেষবারের মতন চোখ বুলিয়ে নিচ্ছি এমন সময় দেখি সুজাতা ঘোর গরমের মধ্যে উইন্টারের ফুলহাতা শার্ট আর বড় ঝুলের স্কার্ট পরে জড়োসড়ো ভঙ্গিতে ক্লাসে ঢুকছে। ওর মাথা জুড়ে অরেঞ্জ কালারের সিঁদুর। গোটা ক্লাস ওকে দেখে চমকে উঠল। ঠিক যেমন পুপলাদির বিয়ের দিন রেকর্ড কেটে গিয়ে বিসমিল্লাহ খানের সানাই বেসুরো হয়ে বাজতে বাজতে থেমে গেছিল।
- এ মা! এটা কি? জুবেদার 'কি' শব্দের উচ্চারণের মধ্যেই একটা হাহাকার টের পাই । আমাদের পনের ষোল বছরের জীবনে এমন অদ্ভুত ঘটনা কি এসেছে নাকি?
- অন্যের বিয়েতে নিয়ে গিয়ে তোর বিয়ে দিয়ে দিল ওরা? পার্টনার উপালীর গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে।
আশির দশকেও যে এমনধারা ঘটনা ঘটতে পারে, তাও আমাদের মতন উচ্চ মধ্যবিত্তদের বাড়িতে এটা একেবারেই অবিশ্বাস্য । বাহ 'উপরালা' এই বুঝি উপরালাদের মতন কাজ হল ?
পরীক্ষার খাতা পত্তরের ডাঁই নিয়ে ক্লাসে মিস কৃষ্ণা ঢুকলেন। ক্লাসে পিন ড্রপ সাইলেন্স । সুর তুলে 'গুড মর্নিং মিইইইস' বলতেও ভুলে গেলাম আমরা।টেবিলে খাতাপত্তর রেখে মিস সুজাতার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললেন
- পড়া ছেড়ে দিও না সুজাতা। কষ্ট হলেও চালিয়ে যেও। উই অল আর উইথ ইউ।
সুজাতা কেমন একটা অদ্ভূত হাসি মাখা মুখে তাকিয়ে আছে। হতবাক হয়ে দেখলাম আমাদের বোকা ,সরল বাল্যবন্ধুর চেহারা, হাবভাব, এমনকি চাউনিটাও কেমন বদলে গেছে।
হাসির আড়ালেও যে এমন হৃদয় নিংড়ানো কান্না লুকোনো থাকে এই প্রথম জানলাম।
অপা কে দেখতে কি সুন্দর! কালো চশমার ফাঁকে ঝিলিমিলি চোখ। সব সময় শার্টের হাতায় দুটো ফোল্ড । পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আয়রন করা শার্ট , স্কার্ট । টাইট বিনুনি , মাথার ওপরে কুঁকড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে আটকানো । দিনের শেষে অবাধ্য জুনিয়র বাচ্চা দের মতন তারা খাড়া হয়ে দাঁড়ায় । ওর নীল ব্যাগে আটকানো জলের বোতল থেকে বেঁচে থাকা জলটুকু গলায় ঢেলে বাসে উঠে পড়ে। দেখি ওর মাথা আকাশের দিকে আর নীল বোতলের জল ওর মুখে পড়ছে, আমি মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকি।
সিক্সে উঠে যখন অপরাজিতা কে খেয়াল করলাম তখন ওকে তেমন একটা আহামরি লাগে নি। তারপর একদিন যখন হোমওয়ার্ক না করার জন্য সন্দীপ, বিভু, অপা, নিখিল পানিশমেন্ট খেলাম । বাইরে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মত সন্দীপের সাথে কথা বলতে গিয়ে কাহলী ম্যামের বকা খাচ্ছি তখনই চোখে পড়ল অপার গালের তিল। বারান্দায় কি রোদ ! মে মাসের রোদ্দুরে ক্লাস সেভেনের অপরাজিতা সিন্হা ফেয়ারি টেলের নীলপরী হয়ে গেল। ম্যামের বকুনি, শাস্তি, লজ্জা টজ্জা বেমালুম ভুলে আমি মনে মনে অপার হাত ধরে শাহরুখের মতন টিউলিপ গার্ডেনে ছুট লাগলাম।
অপার জন্য জান কবুল। আমি হলাম টিকু, ত্রিলোক কুমার , সন্দীপ বলে টিকু ভাই। সল্লু ভাই এর মতন আমিও বেশ বেঁটে । অ্যাসেম্বলি হলে হাইট ধরে দাঁড় করালে সেকেন্ড পজিশন । আর অপা সেই ফাইভ থেকেই একদম পিছনের দিকে । আমার কি হবে ?
সন্দীপ বলেছে ঝুলে থাকলে হাইট বাড়ে। দাদাকে বলে কয়ে একটা রিং লাগা করালাম বাথরুমের পাশের বারান্দায় । যখন পারি ঝুলে পড়ি। কাঁধের চাইতেও ছোট ছেলে কে কোন মেয়ে পছন্দ করবে ? বড় স্কেল দিয়ে দেওয়ালে মেপে মেপে হদ্দ। দুবছরের চেষ্টায় বেড়েছি মোটে এক ইঞ্চি ।
আমাদের মকানমালিকের ছেলের বিয়ে হল বৌদির নাম তপতী। খোকাদা ডাকে তপা , তপাআআ!
আমিও সেই দেখে ডাকি অপা-আ-আ। আরে নাহ্ জোরে জোরে না !
পা-গল নাকি? মনে মনে। মনের ভিতরে থাকে নীলপরীর মহল। সোনার জুতো পায়ে রুপোর চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায় সে। আমি ওর গালের তিলটা আলতো করে ছুঁয়ে দেখি। বিলকুল অসলি পরী।
জিওগ্রাফি ক্লাসে আমি হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে অপা কে নিয়ে হাঁটি । আল্পসের বরফে স্কেটিং করি। ঘন নীল প্রশান্ত মহাসাগরে ডুব দিই।
হিস্ট্রি ক্লাসে দুজনে মিলে একসাথে স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি
- অঙ্গরেজো ভারত ছোড়ো।
তুর্কী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে ছুটে যাই জঙ্গল গাঁও পেরিয়ে।
সবচাইতে ভালো লাগে ইংরেজি ক্লাসে। সীমা ম্যামের হাস্কি গলা, কাজলটানা কালো চোখ, লম্বা বিনুনি আর শাড়ি পরার স্টাইলে গোটা হাই স্কুল ফিদা। ম্যাম আমাদের স্টেজে অভিনয় করার মত করে জুলিয়াস সিজার পড়ান। ওয়ার্ডসওয়ার্থের লুসি কে আমাদের বিবর্ণ ক্লাসে এনে বসান। চারিদিকে ড্যাফোডিল বাহার। চোখ ফোটে। ম্যাম কে খুশি করতে আমরা নানান বই ঘাঁটি , লাইব্রেরি তাক থেকে বই নামাই। কবিতা মুখস্ত করি। কঠিন কঠিন শব্দ খুঁজে পেতে ম্যাম কে অঞ্জলি দিই। এক হেমন্তের সকালে বায়রন আমাকে মুগ্ধ করে।
আমি কল্পনায় হাঁটু গেড়ে বসে পড়ি তার সামনে , গালের কালো তিলের দিকে তাকিয়ে বলি
She walks in beauty, like the night
Of cloudless climes and starry skies;
And all that's best of dark and bright
Meet in her aspect and her eyes
Thus mellow'd to that tender light
Which heaven to gaudy day denies.
হা ঈশ্বর! কেবল সাড়ে পাঁচ ইঞ্চির দুরত্ব আমাকে দুরে সরিয়ে রেখেছে প্রিয়ার কাছ থেকে !
পড়াশোনা যে আর তেমন হয়না তা বলার দরকার নেই। সবকটা ক্লাস টেস্টে জঘন্য নাম্বার উঠেছে। দুটোতে আবার লাল দাগ। মা সেদিন ডাইনিং টেবিলে আধঘন্টা ধরে লেকচার দিল। কি আর করবে বেচারি ? মাসির ছেলে এবার আইভি লিগ। মামার মেয়ে চেন্নাই প্রেসিডেন্সি আর আমি, শ্রীমতী রাধা কুমার , সিনিয়র সাইনটিস্ট এর ছোট পুত্র ত্রিলোক ফেলু !
মা চশমার ফাঁক দিয়ে বলে
-' ম্যান ইজ নোন বাই হিজ কম্পানি। সাচ ডিস্গাসটিং ফ্রেন্ডস ইউ হ্যাভ। লুক এট ইয়োর অন্না ।'
সেদিন চলছে অ্যানুয়াল স্পোর্টসের প্র্যাকটিস। গালে, কপালে এত পিম্পল হয়েছে। সকালেই আয়নায় দেখেছি ছাগলের মতন দাড়ি। হাল্কা গোঁফ । কি আনইমপ্রেসিভ দেখাচ্ছে ! বিশ্রী বিশ্রী!
-' গিভ ভি ওয়ান গুড রিজন টু লাইক মি।'
কিছু একটা করতেই হবে নাহলে যে অপা চলে যায়, লুসির মতন দুরে আরো দুরে।
রেসে কোয়ালিফাই করা কঠিন। তাই জ্যাভেলিন , পোল ভল্টে নাম দিলাম। যদি বাই চান্স লাক ফেভার করে ! হান্ড্রেড মিটারে পারলাম না। বেঁটেদের পায়ের স্টেপটাও ছোট হয়। আধ ঘন্টা পরে জ্যাভেলিনে ডাক পড়েছে। হাউসের ছেলেরা হাততালি দিচ্ছে। ছুটে এসে গায়ের সব শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে দিলাম -শন শন করে উড়ছে বর্ষা । স্যার চিৎকার দিলেন -ওয়েল ডান । পারফেক্ট থ্রো। শর্মা আর সন্দীপ মেপে চেঁচিয়ে উঠল ফিফটি পয়েন্ট টু স্যার। স্যারের হাততালিতে অনেকে তাকিয়ে দেখল আমায়। জ্যাভলিনটা আমার দিকে ছুঁড়ে বললেন স্যার
- ওয়ান্স মোর। আরেকবার দেখি । আরো ভালো করার চেষ্টা করো।
আগের বার তো তেমন কোনো প্রস্তুতি ছিল না । এবার অনেকের দৃষ্টি আমার দিকে। কান লাল হয়ে গেছে , ঘাড় গরম।
আমি বেঁটে , আমি ফেলু..
-' অব্বে টিকু ভা-ই ! চল চল। সন্দীপের গলা শোনা যায় ।
ছুটতে শুরু করলাম। জুতোর আওয়াজে রিদমটা বোঝা গেল।
খপ_খব ,খপ-খব, খব খব খব.....
আমি শিকারি। আমি বাইসন শিকার করব । আদিম মানুষের মতন আমার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছে। আর কিছুই শুনতে পাই না। শক্ত করে বর্শা ধরা হাত কাঁধের কাছে । চোয়ালের পেশি শক্ত । ছুটতে ছুটতে লাইনের ঢের আগেই দিলাম ছুঁড়ে । বিউটিফুল আর্চ তৈরি করে তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে জ্যাভলিন মাটিতে বিঁধে গেল। এবারেও স্যার হাততালি দিলেন আর বললেন
- আরে তোর তো ন্যাচারাল ট্যালেন্ট আছে!
প্রশংসা পেলে কার না ভালো লাগে? গর্বে বুক ফুলে ওঠে। বড় বড় নিশ্বাস ফেলে সন্দীপের দিকে তাকাই । কতটা গেল এবার তা কে জানে ?
হঠাৎ ডান পায়ের হাঁটুর পিছনে এক নিদারুণ ধাক্কা আর আমি সোজা ক্যাক্ শব্দ করে মাটিতে। ডান পায়ে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করতে করতেই জ্ঞান হারালাম।
মুখে জলের ঝাপটা ভিজে শার্ট আধভেজা প্যান্টালুন , চোখ খুলে দেখি অনেক মুখের ভীড় আর নীল আকাশ , ডান পা নাড়ানো যাচ্ছে না , দেখতে দেখতে পা ফুলে ঢোল ।
সেভেনের থ্রো প্র্যাকটিস করতে থাকা কারোর হাত থেকে শটপাটের লোহার বলটা এসে আমার পশ্চাৎদেশ মিস করে হাঁটুর পিছন দিকে ধাক্কা মেরেছে । হাঁটুটা যে ভেঙ্গেছে তাতে সন্দেহ নাই।
- ভাই! টিক্কু ভাই কামাল কিয়া তুনে । সাড়ে পচপন । ফিফটি ফাইভ এন্ড এ হাফ।
শালা সন্দীপ নৌটঙ্কি এখনো আমাকে স্কোর বাতাচ্ছে।
তবে কিনা , সাড়ে পঞ্চান্ন ! গ্রেট ! অত ব্যথার মাঝেও বুঝলাম হল একটা কিছু। জাতে উঠেছি।
চেঁচানো যাবেনা। মর্দ কো দর্দ নহী হোতা।
স্যারের কোলে চড়ে যেতে যেতে ভাবছিলাম অপা কি দেখল নাকি?
অপারেশন হল। টানা সাত দিন হাসপাতালে । তারপর পাক্কা একমাস বাড়িতে বন্দি ।
কত ছেলেমেয়েরা এল দেখা করতে -নট অপা। এক্সমাস হলিডেতে কালপ্রিট দীপ্তেশ আর রাহুল হাতে সরি কার্ড , চকলেট নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ওদের পেরেন্টদের সাথে এসে দেখা করে গেল। আহা সেভেনের বাচ্চা ছেলে, হাত থেকে ছেড়ে গেছিল।
মুখে বলি -নো প্রবলেম আর মনে বলি -থ্যাংক ইউ ফর এলাউইং মি টু ড্রিম।
পরীক্ষা ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে। ফেল করলে রাধা কুমার নির্ঘাত অন্য পা টাও ভেঙ্গে ফেলবে । খাতা বই উল্টে পাল্টে দেখি।
ঠিক বিয়াল্লিশ দিন পর প্লাস্টার করা পা টেনে টেনে স্কুল গেটে ঢুকতেই বুক ঢিবঢিব। ভীড়ের মধ্যে বন্ধু দের সাথে দাঁড়িয়ে অপা !
my heart leaps up when I behold a rainbow in the sky..
সবাই হইহই করে অভ্যর্থনা জানায়। ওদের কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম দুবছর রিংয়ে ঝুলে ঝুলে যা হয়নি , দেড় মাস বিছানায় শুয়ে বসে তা হল। আমি আমার রেনবোর প্রায় সমান সমান হয়ে গেছি ! তাহলে এবার কি একটু ছুঁয়ে দেখব নাকি ?
জামার রঙ হলুদ
আমাদের স্কুলে সিংহভাগই আর্মির ছেলেমেয়ে । সিভিলিয়ানদের সংখ্যা হাতে গোনা যায় । আমরা দেখি ওদের জগতটাই কেমন আলাদা।
ওদের ক্যান্টিনের সস্তা জিনিস, মেস, ব্যারাক, বল ডান্স, স্যাটারডে পার্টি, আদবকায়দা । আমাদের ছাপোষা মধ্যবিত্ত জীবনের উইকএন্ড মানে রবিবারের মাংস ভাত।
ওদের ক্রুকাট ছোট চুল ,আমাদের ঢিলেঢালা পাজামা ,ধুতি।
ওদের স্মার্ট হাই হিল, স্কার্ট থুড়ি ড্রেস পরা মম্মা, আমাদের ঘরোয়া শাড়িতে হাত খোঁপা মা।
বন্ধু হলেও আমরা-ওরা বিভেদটা ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পেরে গেছি। আমার বেস্টি দেবু বলে ওদের মধ্যেও নাকি ক্লাস ডিফারেন্স আছে। ডিফেন্স এর অফিসার আর নীচু তলার জওয়ানের ছেলেমেয়ে এক না। তবে এসব কথা বলি চুপি চুপি।
সেদিন কেমন বিক্রান্তের বাবা গটগট করে ক্লাসে ঢুকে এলেন। রিতা ম্যাম চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে হেসে হেসে কথা বললেন। বিক্রান্তের বাবা বুঝতেই পারলেন না যে ম্যাম কি ভীষণ রাগী। পেরেন্ট টিচার মিটিংয়ে দেখেছি সুরজ, নেহাদের বাবারা কি রকম সংকুচিত হয়ে থাকে। উঁচু তলার বাবা মায়েরা ব্যক্তিত্বের সাথে গটগট করে হাঁটে ,ফসফসিয়ে ইংরেজিতে কথা বলে।
সংহিতা ভর্তি হয়েই ক্লাসে সেকেন্ড হল বলে ঋতুর মাম্মি চার্জ করল। রীতা ম্যাডামের মুখ কাঁচুমাচু !
আমাদের স্কুলটা একদম তাসের দেশ-
তোলন নামন
পিছন সামন,
বাঁয়ে ডাইনে
চাই নে চাই নে..
এইটে উঠে আমি হলাম প্রিফেক্ট। অনেএক দায়িত্ব । চক আনা, টিচারের পিছনে খাতা বয়ে নিয়ে যাওয়া, দুষ্টুমি করলে চুকলি করা, ইউনিফর্ম চেক করা এইরকম আর কি?
একসময় খেয়াল করলাম কিছু ছাত্র-ছাত্রীদের জামার রং হলুদ।
-' হোয়াইট শার্ট সাদা নয় কেন ? সাবান দিয়ে ঘষবে।
একদিন মায়ের পরামর্শে ওদের বললাম নীল দিতে।
তাতে আরো গন্ডগোল । কারণ অফ হোয়াইট রংএ নীলের ছোপ স্কুল ড্রেসের কালার বদলে গেল। কর্তব্যের গাফিলতিতে নিজের ওপরেই বেশ বিরক্ত হলাম।
রেশমার ড্যাড মেজর চৌহান এর সাথে এক দল বাবারা বদলি হয়ে চলে গেছে । পরিবারেরা আপাতত এখানেই থাকছে। দেওয়ালির ছুটির পর ওরা চলে যাবে। রেশমা আমাদের গরমাগরম সীমান্ত যুদ্ধের খবর দেয়। চৌহান আঙ্কল ভীষন স্মার্ট , চৌকস। কালো চশমা মাথার ওপরে তুলে রাখলে স্টাইলিশ লাগে সেটা আঙ্কল কে দেখে শিখেছি। এমন লোক যুদ্ধে যায়, গান চালায় ভাবতেই অবাক লাগে।
একদিন এসেম্বলিতে অ্যানাউন্স করা হল পরমজীতের বাবা রাজস্থানের বর্ডারে শহীদ হয়েছেন। পরমজীত ক্লাস ফোর, আমারই হাউসের ছেলে বলে চেনা মুখ । ওর ছোট বোন - ওয়ান বি।
একমিনিটের মৌন। রেশমা আমাদের পরে সব ডিটেলে শোনাবে। আমরা খুব উত্তেজিত ।
আর্মি ছেলেমেয়েরা বাবার মৃত্যুর খবরে তেমন ভেঙ্গে পড়ে না।
শহাদত ।
সন্তানেরা -শহীদ কে বচ্চে।
স্ত্রী- শহীদ কী বেওয়া( বিধবা)। রেশমার শেখানো কথা থেকেই বুঝলাম ওরা আমাদের থেকে সত্যিই আলাদা। তিনদিন পর থেকেই পরমজীত আর ওর বোন স্কুল আসতে লাগল। কান্নাকাটি নেই , হাহুতাশ নেই। কেবল পরম একটু চুপচাপ। ওরা কলকাতাতেই থেকে গেল , স্কুলের ফিস আর্মি ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন থেকে মাফ হয়ে গেছে কিনা।
দেখতে দেখতে পরমজিত্ আর ওর বোনের সাদা শার্ট হলদেটে । এরপর আমি পরপর তিন বছর প্রিফেক্ট ; স্টুডেন্টের হলুদ জামা নিয়ে কোনোদিন প্রশ্ন তুলি নি।
লালির সোয়াস্তি
দাদার আপত্তি সত্তেও পঞ্চান্ন বছর বয়সে কৃষ্ণাদির গাড়ি চালানো শেখার ভয়ানক ইচ্ছে জাগল। সানরাইজ ড্রাইভিং স্কুলের মালিক ড্রাইভিং মাস্টার বিশুকে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল এ কাস্টমার হল দুধভাত । নিয়ম রক্ষার মতন পঁয়তাল্লিশ মিনিট পার করলেই হল। পরের দিন থেকেই বিশু মাস্টার ঠিক সাড়ে এগারোটায় ট্রেনিং কার নিয়ে হাজির। দিদির উৎসাহের ঠিকানা নেই। তিন চার দিনেই গাড়ি দিব্যি চলছে। বেচারি বুঝতেই পারছে না যে গাড়ির আসল কন্ট্রোল কিন্তু বিশুর পায়ে। এ গলি, সে গলি , বড় ছোট রাস্তা পেরিয়ে বিশু ট্রেনিং শেষ হবার মুখে গাড়ি গোলপার্ক অব্দি ঘুরিয়ে আনল।
এর পর কৃষ্ণাদি কে দেখে কে? মহানন্দে জনে জনে ফোন করে জানিয়ে দিল সুসংবাদ । একদিন যথানিয়মে হাতে এল পাকা লাইসেন্স । তারপর ? তার আর পর নেই। এক শুভদিনে নিজের লাল ছোট্ট গাড়িটা গ্যারেজ থেকে বার করতেই আন্দাজের গোলমালে সামনের দেওয়ালে লাগল এক ধাক্কা ! কপাল জোরে বাঁদিকের হেডলাইটের কাঁচের ওপর দিয়ে গেল। এরপর ছোট্ট লাল গাড়িটার আতঙ্ক দেখে কে? কৃষ্ণাদি প্রতিদিন গাড়ি বের করবেই। আমরা গাড়িটার গোঁ গোঁ প্রতিবাদের শব্দ শুনি। তা মানুষের প্রতিবাদেই লোকে কান দিচ্ছে না সেখানে এক জড় চেতনাহীন গাড়ি ! সাতদিনের গাড়ির খোলসে ঘসে জায়গায় জায়গায় রং উঠে ঘা হয়ে গেলো। কুছ পরোয়া নেই । দাদা ভীষণ রাগ করলেন ।
- রং করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে । শিখতে গেলে অমন একটু হবেই। কৃষ্ণাদি উবাচ।
পেট্রলের দাম কত বেড়ে গেছে , অকারণে গাড়ি চালিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে গায়ে লাগে না ? তাই কৃষ্ণাদি কেবল সুযোগ খোঁজে স্টিয়ারিং ঘোরানোর। নাটুদার বৌ বাজার চলল অমনি কৃষ্ণাদি ছাদ থেকে উঁকি মেরে হাঁক পাড়ল
-অ্যাই সবি দাঁড়া চল তোকে বাজারে ছেড়ে আসি ।
সবিতার মুখ শুকিয়ে আমসি। দুএকদিন গিয়েই বুঝতে পেরেছে যে পরের চার চাকার চে তার নিজের পা-গাড়িটি ঢের ঢের ভালো।
পরোপকারী কৃষ্ণাদি হাতছানি দেয় নিনা চল তোকে কলেজে ছেড়ে আসি। নিনা ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বাঁ হাত নেড়ে চলে যায়।
বড়রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাফিক পুলিশটি মুখচেনা। বিশেষ যত্ন নিয়ে সে কৃষ্ণাদির লাল ছোপলাগা বাহন লালিকে রাস্তায় তুলে দেয় । পেট্রল পাম্প এর কর্মচারীরা ডব্লিউ বি জিরো ওয়ান....96 দেখলেই সাবধান হয়ে হাঁকহাকি করতে থাকে। আসলে একদিন হাওয়া চেক করাতে গিয়ে কৃষ্ণাদি উবু হয়ে বসে থাকা কর্মচারী হাবুলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিল। নেহাত গাড়ির স্পীড ছিল দশের কম আর পাশের সিটে বসে থাকা দাদা সময়মতো হ্যান্ড ব্রেক টানতে পেরেছিলেন তাই এখনো বেচারিকে আনহার্মড দেখা যায় ।
সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দাদা পাড়ার সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাবধানবার্তা দিয়ে এলেন। এরপর যারা ফ্রিতে এই অ্যাডভেঞ্চারে অংশগ্রহণ করতে চায় তারা করুক।
-অ্যাট ইয়োর ওন রিস্ক।
তারপর থেকে কৃষ্ণাদিকে দেখলেই অনেক মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কেও বা খোঁজে বাহানা আবার কিছু না মনে এলে অনেকেই এক ছুটে ঢোকে টয়লেটে।
আমার বেলা কোনো অজুহাতই খাটছে না। আমি হলাম গিয়ে কৃষ্ণাদির পছন্দের মানুষ। বহুকালের পড়শি আছি। মোচা, থোড়, কাচকি মাছ রান্না করে বাটি চালাচালি করি। আবার বেনারসি ল্যাংড়া থেকে দরবেশ, জলভরা, দ্বারিকের সন্দেশ সবই ভাগ করে খাই। 'যাব না গো, বড্ড কাজ পড়ে গেছে' বলা আমার পক্ষে নিতান্তই অসম্ভব । সুতরাং কোথাও যেতে হলেই
আমার ডাক পড়ে। ভোরবেলা গড়ের মাঠ হয়ে থিয়েটার রোডের অরবিন্দ ভবন, গড়িয়াহাটের বাজার , কৃষ্ণাদির বাপের বাড়ি , লেক গার্ডেনের বান্ধবীর বাসা ... আমার কাজ পাশে বসে বাঁদিকের রিয়ার ভিউ মিরারে চোখ রাখা। সামনের দিকে স্পেসের আন্দাজ রাখা। একশ দশ ভাগ মনঃসংযোগ দিয়ে ডান হাতটাকে হ্যান্ড ব্যাকের পাশে এলার্ট রাখা। বেগতিক দেখলেই হেইঁয়ো টান।
কৃষ্ণাদি জম্পেশ করে বাংলাদেশের শুঁটকি রেঁধেছে। এ দেব ভোগ্য অমৃত একা খেলে মহা পাপ। তাই গোটা কয়েক বাটি ভর্তি চচ্চড়ি বিলিবণ্টন করতে বের হলাম। গোলপার্ক দিয়ে ঘুরে গড়িয়াহাট ব্রিজে উঠব উঠব। সেকেন্ড গিয়ার টুকটুক করে মিনিবাসের পেছন পেছন চলছে লালি । এমন সময় এক বৃদ্ধ লগবগ করতে করতে রাস্তা পার করতে লাগলেন। গাড়ির গতি আরো কমে গেল আর ভয়ে অ্যাক্সিলেটরের চাপ বেড়ে গেল । আমি আতঙ্কে সিটটাকেই প্রানপণে খামচে ধরেছি। পেছনের লাল মস্ত সরকারী বাস প্রায় ঘাড়ের ওপর। গড়িয়াহাটের বিপুল জনস্রোত কোন মন্ত্রবলে যেন স্ট্যাচু । গরগর করে লালি কত কি বলে যায়। আমার বাঁ চোখ দৈত্যের মতো এগিয়ে আসা বাসটাকে দিকে আর ডান চোখ অর্জুনের মত বৃদ্ধের দিকে নিবদ্ধ । দৃষ্টি ছাড়া অন্য ইন্দ্রিয় গুলো সাময়িক বিরতি নিয়েছে। ধাক্কা লাগবে লাগবে করতে করতে দেখলাম বৃদ্ধ ফুটপাতে উঠে পড়েছেন। আমার মিনি হার্ট অ্যাটাক হতে হতেও হল না। মুহূর্তের জন্য বোধকরি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। এরপর দেখি গুটিকতক পরোপকারী পথচারী হাতটাত দেখিয়ে লালিকে ব্রিজে উঠতে সাহায্য করছেন।
নির্ধারিত স্টপে গাড়ি পার্ক করা দুরূহ কর্ম। শেষে এক ট্যাক্সিচালকের সাহায্যে এক সেফ কোণে লালিকে দাঁড় করিয়ে চট করে মানিপিসির কৌটো ডেলিভারি দিয়ে এলাম আমরা । পরের ডেলিভারি গরচাতে ভুতোদার বাড়ি। কি কান্ড গাড়ি স্টার্ট করলেও এগোয় আর না। গর্জে গর্জে প্রতিবাদ জানাচ্ছে । পঞ্চাশ মিটার এগোতে আমরা গলদঘর্ম হয়ে গেলাম। অথচ একটু আগেও দিব্যি চলছিল।
-'ট্যাক্সিচালকের হাতে স্টিয়ারিং ছাড়াটাই উচিত হয় নি। কি করে দিল লোকটা কে জানে?'
কৃষ্ণা দির শুকনো গলা।
-' মিস্ত্রি ডাকব? বলতে বলতেই চোখ গেল হ্যান্ড ব্রেকের দিকে। দেখি সে ব্যাটা মাথা উঁচু করে আমার দিকে প্যাট প্যাট করে চেয়ে আছে।
সেদিনের বুক ধড়ফড়ানি কমতে পাক্কা দুদিন লাগল ।
ডোভার লেনে গান শুনতে যাব কৃষ্ণাদি বিকেল হতেই লালিকে নিয়ে রেডি।
- হ্যাঁ গো লালিকে রাখবে কোথায়? সশরীরে উপস্থিত হতে পারলে তো গান, আবার ভাগ্যক্রমে পৌঁছে গেলে আবার ফেরার টেনশন । কি দরকার হেঁটেই চলো না গো।দিব্বি গুনগুন করতে করতে যাবো আর আসবো।
আমার প্রবল আপত্তি তে কর্ণপাত না করে কৃষ্ণাদি গটমটিয়ে চাবি হাতে করে নেমে পড়ল। দুটো গাড়ির মাঝ থেকে বেরোনোর সময় পেছনের গাড়িতে লাগল লালির আদরের ছোঁয়া । বলা যায় মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পৌঁছালাম। মিলিদির বোন তুলির সাথে বহুদিন পর দেখা। মিলিদি সুন্দর গান গায়। সুরের পরশে, আড্ডায় রাত কাটল বড় আনন্দে ।
সকালবেলা দলদল মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতারা বেরোচ্ছি । ললিতের সুর গুনগুন করে মিলিদি। কৃষ্ণাদির মুখে অনির্বচনীয় আনন্দ । সুরের আবেশে ভাসতে ভাসতে হাঁটছি। হঠাৎ মিলিদির দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণাদি বলে উঠল
-' চল তোদেরকে পৌঁছে দিই।'
সুরের আকাশ থেকে পপাত ধরণীতলে। আবার?
-' না না থাক না।' মিলিদির সুরেলা আপত্তি ।
-' তাতে কি? মেনকা সিনেমার পাশ দিয়ে সোজা তোমাকে নামিয়ে বাড়ি চলে যাব। কোনো অসুবিধা নাই।'
আমার আবার বুক ধড়ফড়ানি আরম্ভ হল । হায় হায় পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতেই হবে সাথে! শহীদের মতন বুক চিতিয়ে লালির দিকে এগোলাম। ওমা সামনে পিছন ফাঁকা ! গাড়ি দুটোই কখন চলে গেছে। আনন্দে দু পাক ঘুরে নিই।
-' মা মাগো, মা তুমি আছো। সত্যি আছো।'
গাড়ি এগোচ্ছে এমন সময় এক মহিলার ভীষণ ভাবে হাত নাড়া দেখে কৃষ্ণাদি একদম প্রো স্টাইলে ঘ্যাঁচ করে গাড়ি থামালো।
-' আমাকে একটু সামনে নামিয়ে দেবেন প্লিজ ।
লালির গোঁ গোঁ আপত্তি সত্বেও তুলি দরজা খুলে দিল। এঁকেবেঁকে গাড়ি এগোচ্ছে । মিলিদি হঠাৎ গলা খুলে গাইতে লাগল গুরুদেব দয়া কর দীনজনে...
ভদ্রমহিলার কাতর গলা শুনতে পেলাম
-' আপনি কি নতুন চালাচ্ছেন দিদি? '
রিয়ার ভিউ মিরারে চোখ রেখে কঠিন গলায় বললাম
-' বিরক্ত না করে ঠাকুরের নাম করুন প্লিজ ।'
সেদিন গুরুদেব দীনজনদেরকে সত্যিই দয়া করেছিলেন । ভদ্রমহিলাকে নামিয়ে আমরা মিলিদি আর তুলিকেও অক্ষত দেহে নামাতে সক্ষম হলাম। কেবল বাড়ি ফিরে গ্যারেজে ঢোকার মুখে হেই হেই করতে করতেই আমার দিকের মিরারটি গুঁড়িয়ে গেল । ভাঙ্গা কাঁচ সেলোটেপ দিয়ে জোড়ার অনেক চেষ্টা হল। আমি আবার জিগসও পাজেল মোটেই সলভ করতে পারি না।
-' কি আর করবে জন্মালে মরিতেই হবে। জড় পদার্থের মৃত্যু তো আর নিউমোনিয়াতে হবেনা । দাদার এহেন উদার মন্তব্য আমাকে বিছানার দিকে এগিয়ে যাবার সাহস দিল।
এই ভাবেই উত্তেজনার পারদ ওঠে নামে আর আমাদের দিন কাটে ।
হঠাৎ পতিভাগ্যে আমাকে বাস্তুচ্যুত শহরচ্যুত হতে হল। কৃষ্ণাদির শোকাহত মুখ দেখে সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পাই না। আহা সবে হাত পেকে উঠেছিল। ছলছল চোখে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
প্রায় ছ মাস পর কলকাতা কাজ পড়ল। আমার বন্ধুভাগ্য খুবই ভালো। কার কাছে থাকব এই নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। প্লেন ওড়ার মুখে শ্যামের বাঁশি বেজে উঠে। এই রে কৃষ্ণাদি ! বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দিলাম। আবার বাজে সে। বারবার কি আর কাটা যায় ? ফোনটা তুলতেই সেই উত্তেজিত গলা
-' বাইরে চলে এসে দাঁড়িও। আমি নিতে আসছি। বন্ধ ডেকেছে। শহরে তুমুল উত্তেজনা । '
হাঁ না বলার সুযোগ নেই বিমানবালা চোখ পাকাচ্ছে।
বাইরে বেরিয়ে দাঁড়ানোর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই লালিকে গড়গড় করে এগিয়ে আসতে দেখে কিন্তু সত্যিকারের আনন্দ হল। জানলার কাঁচ নামিয়ে দুই বন্ধু ফাঁকা রাস্তা দিয়ে উড়ে যাচ্ছি। হাওয়ায় উড়তে থাকা চুল সামলে বলি
-' বেশ ভালোই চালাচ্ছ গো।'
কৃষ্ণাদির মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল।
-' দাদা কি বলছে আর বকে না তো?'
মিনিবাস কে অনায়াসে পাস কাটিয়ে কৃষ্ণাদি গলা পাই
-' বকবে না কেন? ওদের ব্যঙ্গ বিদ্রুপ কে মনে করি দুর্গন্ধযুক্ত হাওয়া । ধাপার পাশ দিয়ে গেলে যেমন বদ গন্ধ আসত আমরা অগ্রাহ্য করতাম, তেমনিই ওদের কথা মনে ধরি না। '
বাঁ হাতে নবটা ঘুরিয়ে গানটা জোরে করে দুজনেই গলা মেলালাম .... এই পথ যদি না শেষ হয়...
রংচটা লাল ছোট্ট লালি তালে তাল মিলিয়ে প্রশান্তচিত্তে সোঁ সোঁ করে কলকাতার রাজপথ দিয়ে এগিয়ে যায়।
টিপু দ্য চ্যাম্প
আদিত্য দের কুকুর টিপুকে চেনে না এমন লোক এই সোসাইটিতে কম আছে। টিপু একটি শান্তশিষ্ট , হালকা বাদামি রংয়ের ল্যাব্রেডর। বি উইংগের চোদ্দতলার কোনো একটি ফ্ল্যাটে থাকে। টিপুকে কেউ কখনো ডাকতে শোনেনি। দুপুর একটা নাগাদ যখন চারিদিক খাঁ খাঁ , বাচ্চারা ইস্কুলে, মায়েদের দল কাজ সেরে ঘুমোচ্ছে বা টিভিতে মন দিয়েছে। তখন টিপু বাড়ি থেকে বের হয়ে লিফ্টের বোতাম টিপে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে আপন মনে চারিদিক ঘুরে ফিরে দারোয়ানের ঘরের কাছে এসে লেজ নাড়তে থাকে। সত্যি বলছি টিপু মেন দরজার ল্যাচ খুলতে পারে। কলিং বেল বাজাতে পারে। লিফটের G লেখা বোতামটি চিনতে পারে।
সেই সময় যে দারোয়ানই ডিউটিতে থাকুক না কেন টিপুকে তিন নম্বর লিফ্টে তুলে দেয়। লিফট সোজা টিপুকে চোদ্দতলায় দেয় নামিয়ে। টিপুর বড়সড় চেহারা দেখলে কিন্তু সত্যিই ভয় করবে। তবে আমরা যারা ওকে চিনে ফেলেছি তারা সবাই জানি যে টিপু নেহাতই নিরীহ, বোকাসোকা এক কুকুর। আমাদের সোসাইটিতে গুনে গুনে চৌত্রিশখানা বিভিন্ন জাতের পোষা সারমেয় দের মধ্যে আমার বাপু ঐ টিপুকেই পছন্দ। তিনতলার বোসেদের একটি ধবধবে সাদা পমেরিয়ান আছে। মহা খেঁকুরে । দেখতে সুন্দর বলে বড্ড অহংকার। কাছে যাওয়ার জো টি নেই। ভুলক্রমে দেখা হলেই সে দাঁত খিঁচিয়ে আপ্যায়ন করে। সেক্রেটারি পান্ডেজী বলেন কুকুরের স্বভাব মালিকের ওপর নির্ভর করে। বোসেরা লোক ভালো না তাই নাকি তাদের কুকুরের অমন উৎপাতে স্বভাব। এছাড়া চাড্ডা আর মিশ্রা ঘনিষ্ঠ বন্ধু তারা দুজনেই পুষেছে ভোঁতামুখো কুৎকুতে পগ । দেখতে যেমন কুৎসিৎ তেমনিই তাদের বিরক্তিকর স্বভাব। লিফট থেকে নেমেই লবির সামনে হিসি করে ফেলে। চাড্ডা এমনিতেই ভারী অদ্ভুত মানুষ। তার কুকুরের এমন ধারা কর্মের উত্তরে আহ্লাদে আটখানা হয়ে দরাজ গলায় হেসে ওঠে। যেন খুব বাহাদুরি দেখানো হল।
এ বছর ক্রিসমাসের দুদিন আগের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিন কুকুরদের জন্যেও একটা ট্যালেন্ট শো রাখা হল । সত্যিই তো মানুষের বাচ্চারা নিজেদের নাচ, গান ,কবিতাপাঠ ইত্যাদি যাবতীয় প্রতিভা প্রদর্শন দেখাবে সেখানে এই সারমেয়কুলেরা কিছু না দেখালে কি চলে?
শনিবার তেইশে ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার লাম্বা র পরিচালনায় ঠিক আটটায় প্রোগ্রাম আরম্ভ হল। গোটা তিরিশেক নানা সাইজের কুকুরের উপস্থিতিতে কুকুরহীন পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যরা একটু শিঁটকে বসল। ওয়েস্টসাইডের মিউজিকের তালে তালে সবাই নিজের নিজের কুকুরকে মঞ্চে একবার হাঁটিয়ে দেখালো। টিপু আসতেই সিটি আর করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রাঙ্গণ। টিপুই আমাদের হিরো।
টিপুওওও টিপু , টিপুওওও টিপু! বাচ্চাদের দল টিপুকে চিয়ার আপ করে।
একটু দুরে দুরে ছোট ছোট বালতি উল্টে রাখা আছে। প্রত্যেক কে এঁকেবেঁকে জিগ জ্যগ ভাবে হেঁটে দেখাতে হবে। প্রথমেই চাড্ডা আর মিশ্রা পরপর যথাযথ ভাবে টাস্ক সেরে ফেলল। দেখা গেল অনেকেই আবার লেজের ঝাপটায় মার্কার মানে বালতি ফেলে দিচ্ছে। নীতুদের বিগাল একটু দুর থেকেই কি যেন শুঁকতে শুঁকতে একেবারেই অন্য দিকে হাঁটা দিল। তাকে টেনেটুনে আনা যায় না। রগড় দেখে লোকে হেসে বাঁচে না। বোসবাবু বুক ফুলিয়ে নিজের পমকে বেশ টুকটুক করে হাঁটিয়ে ফেললেন। এর পর টিপু আসছে। হাততালি হৈ চৈ কিন্তু টিপু কে কোনোমতেই স্টেজে তোলাই গেল না। সেই যে সিঁড়ির কাছে থমকে দাঁড়াল সে আর নট নড়নচড়ন। আদিত্য, তার বাবা মায়ের কোনো ট্রিক কাজ করল না।
রিংয়ের ভেতর দিয়ে ঝাঁপানো, টেবিলে ওঠা, বিস্কিট খাওয়া যাবতীয় কঠিন কাজ সুন্দর ভাবে সেরে বোসের দুধসাদা স্নোবল ফার্স্ট হল। বোসের তাচ্ছিল্যের হাসি আর গমগমে গলা শোনা গেল
-' সাইজ ডাস নট ম্যাটার ইয়ু সি'।
এরপর মানুষের প্রোগ্রাম আরম্ভ হল তবে কোথায় যেন সুর কেটে গেছে।
পঁচিশে ডিসেম্বর অনেকেই বেড়াতে গেছে। সোসাইটি প্রায় ফাঁকা। এর ফাঁকে লিফ্ট , ইলেকট্রিক কানেকশন, মেনটেন্যান্সের কাজগুলো সারা হচ্ছে। এক সকালে ওয়াচম্যান মিউ মিউ শব্দ শুনে দেখে রংয়ের কৌটো বালতির একপাশে বাগানের দিকে সাদা কালো তিনটে বিড়ালছানা ! অল্প সময়ের মধ্যেই শিশুদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। কে দুধ আনবে, কে রুটি খাওয়াবে এই নিয়ে তাদের উৎসাহ দেখার মতন। বেবীদের এখনো চোখ ফোটে নি। তুলোর বলেরা মিউ মিউ করতে করতে গড়াচ্ছে । মা বিড়াল তার স্বভাব মতন আজ এই গাড়ির তলায়, কাল ওই গাছের কোণে বাচ্চাদের নিয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় । এই দেখে সোসাইটি চ্যাম্পিয়ন স্নোবলের প্রবল আপত্তি । রোঁয়া ফুলিয়ে, সরু গলায় চেঁচিয়ে মেঁচিয়ে তাদের ভয় দেখায় । বোসের হাতের বেল্ট ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবার জোগাড় । এছাড়া নীতির বিগ্যালকেও অল্প আপত্তি জানাতে দেখা গেছে। দেখেশুনে শিশুদের দল ঠিক করল যে তারা টিপুর বাবার কাছে আর্জি জানাবে যাতে আপাতত টিপু কে একলা না ছাড়া হয়। কতদিন আর মা টা বাচ্চা দের আগলে রাখবে?
-" হি ইজ হিউজ !"
-" যে কেনো কথা হলে সেক্রেটারি কে জানাতে হয়।" বুবকা বলে উঠল।
-" সেক্রেটারি কি করবে? আদিত্য ভইয়া কে বললেই হবে।"
-" টিপু রেগে বাচ্চাগুলোর কাছে গেলে ওরা তো মরেই যাবে।"
এই সব নানা বক্তব্য, হইচই এর মধ্যে দেখা গেল টিপু হেলতে দুলতে আসছে। মুহূর্তের মধ্যেই সবাই চুপ। কি হয় কি হয় ভাব। টিপু এল, কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপই নেই । একটা গাছের কোলে জলত্যাগ করে আপন মনে মাটি শুঁকে হাঁটতে লাগল। এদিকে মা বিড়াল রোঁয়া, পিঠ ফুলিয়ে যুদ্ধংদেহি ভঙ্গিতে খাড়া । বাচ্চা তিনটে পায়ের কাছে জড়াজড়ি করে শুয়ে । টিপুর উদাসীন ভঙ্গি । হঠাৎ মা বিড়ালটার কি মনে হল একটা ছানা মুখে তুলে এক ছুট্টে গেটের পাশে রেখে ফিরে এসে দ্বিতীয় ছানাটি সবে মুখে তুলছে ততক্ষণে টিপুর নজর গেল ওদের দিকে। অবাক হয়ে টিপু থমকে দাঁড়ায় । কান নড়ে ওঠে তার , যেন সে তার কর্তব্য স্থির করছে। এরপর তীরবেগে ছুটে গিয়ে তৃতীয় শিশুটিকে মুখে তুলে মা বিড়ালের আগেই গেটের পাশে অন্য বিড়াল ছানাদের পাশে নামিয়ে দিয়ে দৃপ্তভঙ্গিতে দাঁড়ায়। মা বিড়াল ততক্ষণে ভীরু পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। টিপু সবার বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে লিফ্টের দিকে এগোতে থাকে। হুইসল আর করতালিতে ক্যাম্পাস মুখরিত।
এখন টিপুর নতুন নাম ' টিপু দ্য চ্যাম্প' ।
ভ্যামপায়ার
-'ছোটবেলায় আর কি বা হত? ছোটবেলা মানেই কুলের আচার, ছু কিতকিত, কুমীর ডাঙা। কোথায় তোদের এসি, ফ্রিজ?
গরম কালে শন শন করে লু এর ঝাপটা , মায়ের শাড়ি, পুরোনো চাদর ভিজিয়ে ঘরে মেলে ঠান্ডা করার চেষ্টা । ভর দুপুরে গোল্ডেএএএন, গোল্ডেনআইসক্রিইইইম ডাক , কাঠের ডালা ফেলার ঠক শব্দ । শুনলেই কমলা রঙের বরফের কাঠি চুষে খাবার জন্য প্রাণ উসখুস করে উঠতো।
মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়ে কোঁচড় ভরা বেলফুল তুলে আনা। জেঠিমা আবার কটা বেলফুল ব্লাউজের মধ্যে রেখে দিতেন। বিকেল হতে হতে সেই গন্ধ জেঠিমার নিজস্ব গন্ধ হয়ে যেত।
রাতের দিকে যখন অসহ্য গরম, ঘামাচি চুলকালে পুটপুট শব্দ, সেই সব দিনগুলোতে চৌবাচ্চার ঠান্ডা জলে স্নান করে পাশের বাড়ির জেঠিমাদের সাথে ছাতে গিয়ে শুতে গিয়ে নারকেল গাছের পাতার সরসর শব্দ । মাথার উপরে তারা ভরা আকাশ দেখতে দেখতে চোখ কখন লেগে যায় কে জানে?
একবার পূর্ণিমার রাতে ফটফটে জোৎসনায় এক অপার্থিব অনুভূতি । মাঝ রাতে হঠাৎ কাক ডেকে উঠে কা-কা করে। আচমকা ঘুম ভেঙ্গে দেখি ন্যাড়া ছাদের ধারে এক আবছা ছায়া। চাঁদের আলো যেন টর্চের মতন চোখে লাগে। উঠতে গিয়ে হাত পা যেন আটকে গেল। একদৃষ্টে চেয়ে থাকি। পিছন ফিরে বসে থাকে সে। ঠিক ভয় না তবে এক অস্বস্তিকর অনুভব। '
-'তারপর ! ' বাচ্চা মেয়েটির সাথে আমার চোখ গোল্লা গোল্লা ।
-' তারপর আবার কি? মা পাশ ফিরে ঘুমের ঘোরে আমাকে জড়িয়ে ধরল। চেনা পাউডারের গন্ধ , মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে পড়ি নিশ্চিন্ত হয়ে।'
-'ঘোস্টটা কিছু করল না?'
-" নাঃ !
-'এঃ বোরিং স্টোরি । '
-' কি করলে ইন্টারেস্টিং হত রে টুনাই?'
-' কি জানি দিদা।'
মেয়েটা ঠোঁট উল্টে বলে
-' এটা তোমার স্টোরি? বাট ইট সাউন্ডস সো ড্যাম বোরিং। আসলে তোমরা ছিলেই খুব বোরিং । কিছু ছিলো না ,টিভি ছিল না, কম্পিউটার ছিল না, ফোন ছিল না। টাইম পাস করতে কি করে কে জানে? '
-' সত্যি তো টুনি রে কি করে টাইম পাস করতাম বল দিকি ? '
' হ্যাঁ এক্স্যাক্টলি পিৎজা ছিল না, ম্যাকডোনাল্ড ছিল না , শপিং মল ছিল না। '
-'তা ঠিক রে আমরা খুব গরিব ছিলাম। আর তেমন বুদ্ধি টুদ্ধি ছিল না তো।'
-' ধ্যাত্ কি যে বলো? আচ্ছা দিদুন গরমকালে ছাতে ঘুমোতে গেলে সত্যিই ঘোস্ট দেখতে পাবো? '
মেয়েটার বয়স খুব বেশি হলে দশ। টিঙটিঙে রোগা। কানের পাশে ক্লিপ দিয়ে আটকানো চুল, চোখে চশমা । দেখেই বোঝা যায় খুব ছটফটে। সামনের বাঙ্কে শুয়ে দিদার কোলে মাথা রেখে গল্প শুনছে। অল্পবয়সী মায়ের রোগার দিকে , পরনে হাল্কা নীল সালোয়ার কামিজ । ফিরোজি রংয়ের ওড়নাটা ভারি সুন্দর। শ্রী মাখা মুখ দেখলেই মনে হয় ভারী ভালমানুষ । ট্রেন চলছে দ্রুতবেগে ।
আমার মাঝের বাঙ্ক। আমার ওপরের বাঙ্কের ভদ্রলোক পাশে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। ওপরের বাঙ্ক খালি থাকলে বেশ হয়।
-' তুমি কি ভূতের গল্প শুনতে ভালবাসো?' খবরের কাগজের আড়াল থেকে বললেন ভদ্রলোক । গলাটা একটু বসা যেন সর্দি কাশিতে ভুগছেন।
- 'আর বলবেন না ।'
- 'তুমি ভূত দেখেছো? আর ভ্যামপায়ার?'
- 'এই দেখো আবার সেই কথা? বলবেন না ও ভূতের গল্প , টিভিতে যত রাজ্যের ভয়দেখানো সিরিজ এই সব পছন্দ করে।' মেয়ের মাথায় হাত বুলাত বুলাতে মায়ের প্রশ্রয় মিশ্রিত গলা শোনা গেল।
- 'ভ্যামপায়ারস ডায়রি আমার খুব ভাল লাগে। জানো ?আমাদের বাড়িতে একটা ব্যাট ঢুকেছিল। তার পর আমাদের পাশের বাড়ির বেড়ালটা মরে গেল। ওরা রক্ত চুষে খায়।'
-' এটা ঠিক কথা না রিনু। বেড়ালটা অনেক বয়স হয়েছিল। আর ভ্যামপায়ার বলে কিছু নেই ।'
-' আছে মা । তুমি জানো না ওরা যাকে টার্গেট করে তারাই ভ্যামপায়ার হয়ে যায় ?'
মেয়েটির মভ কালারের চশমার ফ্রেমের পিছনে চোখে স্পষ্ট অবিশ্বাস । প্লাস পাওয়ার। চোখ দুটো বেশ বড় বড় দেখাচ্ছে । আমার বেজায় হাসি পাচ্ছিল। আমরাও ছোটবেলায় ঠিক এরকমই ছিলাম। যেটা ঠিক মনে হত সেটা নিয়েই পড়ে থাকতাম।
ওয়াশরুম থেকে ছুটে ছুটে ফেরত এসে ব্যাগ থেকে একটা বই বের করল। বেশ মেয়ে তো, আবার বই পড়ছে দেখি !
ওর মা রেলের তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে এসে বসলেন।
- 'চিপ্স্ খাবি? দেবো নাকি?'
-' নোওওও।'
- 'বাহ আজকালকার বাচ্চা চিপ্স রিফিউস করে?'
ভদ্রলোক কাগজ মুড়ে রেখে পা তুলে বসলেন। বেশ অভিজাত চেহারা ভদ্রলোকের, কাঁচাপাকা ব্যাকব্রাশ করা চুল। শ্যামলা রং । পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্ন হবেন।
- 'তোমার মনে হয় সব বাদুড় ভ্যামপায়ার ?'
- 'আপনি দেখেছেন ভুত?' রিনির রিনরিনে গলা শোনা গেল।
- 'নাহ্ ভুত দেখি নি তবে রক্ত চোষা বাদুড় দেখেছি।'
আমরা সবাই চমকে উঠলাম । রিনির মায়ের মুখে এবার স্পষ্ট বিরক্তি ।
- 'আর জানো তো সব বাদুড় কিন্তু রক্ত চুষে খায় না। অন্তত আমাদের দেশেরগুলো তো মোটেই খায় না। এত রকমের প্রজাতির মধ্যে মোটে তিনটে রক্ত চোষা বাদুড় দেখা যায় । তাদের ও আবার আমেরিকা মেক্সিকোতেই দেখা মেলে। রক্ত চুষে খায় তাই ওদের দাঁত সুচের মতো তীক্ষ্ম । শিকারের গায়ে চুপিসারে ফুটো করে জিভের সাহায্যে রক্ত পান করে । ওদের লালা তে এমন কিছু থাকে যা রক্ত কে জমাট বাঁধতে দেয় না। আমি অবশ্য মেক্সিকোতে দেখেছি তাদের।'
- 'মোটে তিনটে ? আর বাকিরা ? বাকিরা কি
খায় ? 'রিনি খুবই অবাক হয়েছে বোঝাই গেল ।
-'বাকিরা পোকামাকড় খায় । কিছু আবার ফলাহারী বাদুড় আছে।'
- ' এমাআআআ ব্লাড না খেয়ে ফ্রুট খায়? '
ভদ্রলোক জোরে জোরে হেসে উঠলেন।
মিষ্টি মেয়েটাকে আমার খুব ভালো লাগছিল।
এর মধ্যেই খাবার চলে এল ।
খেতে খেতেই ভদ্রলোক রিনির দিকে তাকিয়ে বললেন -'তোমার দিদা তো ভুত দেখেছেন বলছেন। '
- 'আমরা চলেছি পটনা । একসময় আমার বাপের বাড়ি ছিল । সে সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে । তাই ছোটবেলার যত স্মৃতি বুড় বুড় করে ভেসে উঠছে । ' ম্লান মুখে জানালেন সৌম্য প্রৌঢ়া ।
প্লেট নামিয়ে হাত ধুয়ে ফেরত এসে বসতে গিয়ে চোখে পড়ল ভদ্রলোকের স্বদন্ত আছে।
কিছু করার নাই অগত্যা বিছানা পেতে শুয়ে পড়লাম। রিনি মাঝের বাঙ্কে ঘুমোতে চায়। এই দিদিটা আছে তো- বলে এমন আবদার জুড়ে দিল।
একটু পরেই সবাই নাজেহাল। উঠছে- নামছে, এই টয়লেট যাচ্ছে, একবার জানলার দিকে মাথা করছে। আবার গরম লাগছে বলে ঢাকা ফেলে দিচ্ছে । আলো নিভিয়ে দিয়েছে। নীল একঘেয়ে আলোতে কখন চোখ লেগে গেল জানিনা।
ভোরের দিকে হঠাৎ চোখ খুলে যেতে দেখি আমার দিকে পিঠ করে একজন মানুষ । সামান্য কুঁজো হয়ে বাচ্চা মেয়েটির দিকে হেলে থাকা শরীর। অদৃশ্য এন্টেনা বিপ বিপ শব্দ ধরল। আমি ওঠার চেষ্টা করতেই লোকটি সোজা হয়ে বেরোতে লাগল। ওহ্ এতো আমাদের সুপুরুষ, সহযাত্রী । মুখ মুছতে মুছতে একহাতে কাঁধের ব্যাগ, জলের বোতল সামলে বললেন - ' সরি, জিনিসপত্র নিতে গিয়ে ঘুম ভাঙালাম নাকি? নেমে যাচ্ছি এর পরের স্টেশনে।'
তারপর সুটকেস, ব্যাগ নিয়ে আধো অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ট্রেন থামল , খানিক পর ঝাঁকুনি দিয়ে আবার চলতে লাগল।
পরের দিন সকালে রিনির মা মেয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছেন। এর পরেই পাটনা জংশন । রাজেন্দ্রনগর ক্রস করলাম। হঠাৎ মনে হল ভোররাতে লোকটা কি করছিল? রিনির মুখের দিকে তাকালাম। আরে মেয়েটার গলার কাছটা লালচে নাকি ? সাত সকালে দিনের ফটফটে আলোয় আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল।
রিনির চোখ আধবোজা। মুখে স্মিত হাসি । ঠোঁটের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে ঝকঝকে তীক্ষ্ম গজদন্ত।
ব্যভিচারিণী/ পতুরিয়া
আজকে বাড়ি ফেরার তাড়া আছে তাই বোধহয় হিসেবের গন্ডগোল । আমি দেখেছি যেদিন আমার কাজ থাকে বেছে বেছে সেইদিনই প্রকাশজীর নানান কথা মনে পড়ে । ঝড় উঠেছে । গুড়গুড় শব্দের সাথে বিদ্যুত চমকাচ্ছে । ঝটপট টাকা গুনে হিসেব মিলিয়ে ছুটে বের হলাম। বৃষ্টি নামার আগে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে।
হাওয়ার চোটে ছাতা খোলাই কঠিন। শাড়ির আঁচল, চুল বেসামাল । দুবার ছাতা উল্টে গেল। আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছাতাটাকে বাগে আনার চেষ্টা করছি এমন সময় দেখি ফুলি শাড়ির কুঁচি তুলে ঘোমটা টেনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে
-' দিদিইইই অব তু হি কুছ করি।'
-' আবার কি করব রে ?'
আমার এখন বাড়ি ফেরার তাড়া । ফুলির দুঃখের গল্পগাথা শোনার সময় নাই। ফুলি আমাদের ব্যাঙ্কে ঝাড়পোঁছের কাজ করে । ওর বর সুরজ গত দুবছর আগে ডেঙ্গু জ্বরে প্রায় মরেই যাচ্ছিল । সেই থেকে ওই বরের বদলে কাজ করছে । হাসিখুশি বউটার চাউনির মধ্যে কি যেন একটা আছে দেখলেই মায়া লাগে। সবুজ চকচকে টিপ পরা ঝলমলে মেয়েটা ভিজে ভিজে আমার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলেই চলে
-' এ দিইদিই তুম কছু করো। একটা দরখাস লিখে দাও। দেখেছো জমিটা বিক্রি করতে পারব না । বলছে ও জমিনটাই নাকি আমাদের না। আরেএএ আমাদের না মানে ? আমার দশ পুশ্তের জমীন তুমি বললেই হল? খেতি করি নি দুবছর। তাই বলেই কি জমীন অন্য লোকের হলো।'
ফুলির উত্তেজিত কান্নাভেজা গলার মাঝে আসল কথা খুঁজি । জলের বড় বড় ফোঁটা, শোঁ শোঁ হাওয়ায় শব্দ উড়ে যায় । ফুলি অনর্গল উগরে চলে । পাঁচটা ছেলেপুলে, বীমার মরদ, বুড়ি সাস , বুড্ডা সসুর ।এই কটা টাকায় আর তো চলে না। আধা জমীন বেচে ও লইকা কে পড়াতে চায়। এখন বাবুরা বলছে ওর নাকি জমিনের কাগজ নাই। আমাকে নাকি দরখাস্ত লিখে দিতে হবে। ওর ছেলেকে ও কলেজে পড়াবেই । চানস মিলেছে কলেজে পড়ার, ও ছাড়বে না। এখানে থাকলে ওর বাপের মতন সরাবী হবে ।
-' তা কাগজ নাই মানে?' মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে রিক্সা খুঁজি । ঝড়ের দাপটে সব রিক্সা ফেলে পালিয়েছে।
-' এ দিদি সালোসাল পুরানা কাগজ সব ছিঁড়ে গেছে বলছে । আবার থেকে লিখতে হবে তাই টাকা লাগবে । টাকা কোথায় পাব দিদি? ঘুষ দেব না খাবার খাব ? দরখাস লিখে দিলে বড়ী উপকার হয় । মজিসটিরেট সাহিবা এখন আউরত । আপনিও আউরত। আউরতের কথা বুঝতে পারবেন সাহিবা । ' আঁচলের কোণা দিয়ে চোখ মোছে।
-' কি যে বলে চলে বউটা।'
প্রথম যখন এই গঞ্জে আসি প্রায় তখন থেকেই এদের চিনি। জাতে কহার সুরজ তখন আমাদের ব্রাঞ্চ ঝাড়ু দেয়, সাফসফাই করে । সেই একদিন নিজের মাকে আমার কাছে বাড়ির কাজের জন্য আনে । অল্প কদিন আমার বাড়ির কাজ করেছে । তারপর তো ফুলি চলে এল। ফুলির আবার ছেলেদের পড়ানোর খুব শখ। সরকারি সকুলে পড়াচ্ছে । মাঝে মাঝে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আমার কাজ কর্ম দেখে। মুগ্ধ চোখে আমার কলম ধরা হাতের দিকে চেয়ে থাকে । বড়াবাবু প্রকাশজি কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ । বাড়ি থেকে জল নিয়ে আসেন আর ফুলির এই লেখা পড়া বাতিক দেখলেই রেগে যান। ছেলে টুয়েলভ পাস করেছে। ফুলির ইচ্ছা শহরের বড় কলেজে পড়ুক।
আজকের ঘটনাটা ঠিক ধরতে পারছি না। বার বার রিক্সার ঘন্টি ক্রিং ক্রিং করে বাজাতে থাকলাম। চেনামুখ।
-' বারিশ কমুক, একটু পরে যাবো দিদি।'
-' পাঁচ টাকা বেশি দেবো , চল চল।'
ফুলিকে বিদায় দিয়ে রিক্সায় চড়ে বসি । হঠাৎ নেমেছে তাই প্লাস্টিকের ঢাকা নাই। জলের ছাঁট ছুরির মতন বেঁধে গায়ে-মুখে। ফুলির উত্তেজিত গলা শুনতে পাই।
-' ছাড়ব না। আমার জমিন। আমার হকের জমিন। পরধানজীর কাছে আমিই চলে যাবো। মরদ যদি চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকে থাকুক। তহসীলদারের কাছে যাবো। যা পারি করবোওওও।' ঝড়ে ওর কথার খন্ড খন্ড শুনতে পাই। রিক্সার লগবগে ঢাকা শক্ত করে ধরে পিছনে চেয়ে দেখি ফুলিয়া তখনো মাঝরাস্তায় দু পা ফাঁক করে আমার দিকে তাকিয়ে । শাড়ি ফুলে উঠেছে কিন্তু মাথার আঁচল ঠিক দাঁতে চেপে, একহাত দিয়ে ধরা ।
ফুলির উত্তেজিত গলা বাড়ি অব্দি ধাওয়া করল। মনে হয় রেজিস্ট্রি অফিসের কম্পিউটারে ওর জমির রেকর্ড তোলেই নি। এরকম আরো একজনের শুনেছিলাম মনে পড়ে। তারা টাকাপয়সা দিয়ে কাগজ ঠিক করে ফেলেছিল। ফুলির ঘটনাটাও এরকমই কিছু একটা হবে।
নতুন দিনের নতুন নতুন সমস্যা । ফুলিয়া আর আমার কাছে আসে না আমিও আর ওর খবর নিতে ভুলে যাই ।
মাস কয়েক পর একদিন অফিসের সামনের বটতলার কাছে ভীড় দেখে কৌতূহলী হলাম। রিক্সা থেকেই দেখা যায় ফুলির শাশুড়ির বুক চাপড়ানো ।
-' অগে মৈয়া গে। পুতোহু ডাইন বা রেএএএ।'
আবার কি হল ? পুতোহু মানে তো ফুলিয়া । সে আবার কি করে ?
-' আরে ঘোর কলযুগ আইল্ রেএএএ। পুতোহু সাস এর গায়ে হাত তোলে দেখেছো ?'
আমাকে দেখে ভীড় একটু সরে যায় । তবে ভীড়ের সহানুভূতি স্পষ্টতই বৃদ্ধার দিকে। একপাশে ফুলিয়া গনগনে চোখে দাঁড়িযে। শাড়ি কাপড় অবিন্যস্ত , আঁচল দিয়ে মাথা ঢাকা গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচালো
-' হাঁ হাঁ মেরেছি। ঠিক করেছি। হাত মুটকে দেবো। জীনগী ভর থুরতে হলই... কই তখন তো কেউ আসো নি বাঁচাতে । আজ দেখি পঞ্চায়েত বসিয়ে ফেলেছো ? '
ওর এমন রণচন্ডী মূর্তি আগে কখনো দেখি নি । মানে মানে সরে পড়লাম। যত্ত সব ছোটলোকদের কান্ড !
-' একে আর রাখা চলবে না।' পাশে হাঁটতে হাঁটতে প্রকাশজি বলেন।
পরের দিন লাঞ্চ ব্রেকে তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করছি। কাউন্টারের সামনে বেশ ভীড় । ফুলি ইতস্তত ভঙ্গিতে এসে মেঝেতে বসে পড়ল। চোখেমুখে স্পষ্ট অনুতাপ ।
-' এ দিদিইই কি যে করি বুড়িয়া আমার কথাই শোনে না। সবাইকে বলে বেড়ায় বহু একদম পতুরিয়া । হাকিমের সাথে শুচ্ছে। সেটামপ বাবুর কাছে থাকছে। রন্ডী ....। '
রুটির শেষ টুকরো মুখে দিয়ে ওর কথা মাঝপথে থামিয়ে, জানতে চাই
-' তা তোর জমিনের কি হল?'
-' জমিন তো আমার দিদিজি। সব ঠিক হয়ে গেছে। অনেক দৌড়াদৌড়ি করলাম। মজিসটিরে সাহিবা হাকিমকে ফোন করল। হাকিম বাবুজি ভলা আদমী । আউর রেজিসটরিবাবু র তো নোকরি চলে যেত । বড়ি ডাঁটলো হাকিম। তারপর কমপুটার তে ভী চড়িয়ে দিল। ' ফুলি তেল চপচপে চুলের বিনুনি ঘুরিয়ে হাসি মুখে বলে ।
-' যাক্ ! অল ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল।'
টিফিনের আলু শেষ করে উঠে পড়লাম । ফুলি মাটিতে থেবড়ে বসেই থাকে । হাত ধুয়ে কাউন্টারের দিকে এগোতে গিয়ে মনে হল ফুলির গল্প যেন ফুরোয়নি। আমার আর শোনার সময় নেই।
বিকেলে অফিস থেকে বেরোতেই ফুলি পেছন ধরল। ও আমার ব্যাগ বয়ে দেবে।
-' সব্জি বাজার করব রে ফুলিয়া।'
-' হাঁ দিদি। করিইই না।'
বাজারের থলিটা বারান্দায় নামিয়ে ফুলি মাটিতে বসে পড়ে।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা ভিজে যায় ।
-' আরো কিছু বলবি ফুলি?'
আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে ফুলি শান্ত গলায় বলল
-' দিদি কি করতাম বলো না? বাড়ির মরদ, দুন্নো মৌগা। অমরওয়া কে বাপু দিনভর ইধরউধর করে সময় বিতাচ্ছে। আর সসুর হুক্কা টানছে আর পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে । কি করব? আমার ছেলেদের এক টুকরা জমিন তোমরা লুটে নেবে আর আমি চুপচাপ দেখতেই থাকব?'
এক মূহুর্তের জন্য ওর চোখ জ্বলে ওঠে, এক স্কেল উঁচু গলায় বলে
-' হাঁ করেছি । পাপ পুন বুঝি না দিদি। হাঁ করেছি করম। '
হাতের চাবি হাতেই থেকে যায়। অনপড় মেয়েটি এক অন্য রূপ দেখি। বিকেলের লালচে আলোয় ওর শান্ত স্মিত হাসিমুখে এক অদ্ভুত আভা। তবে বিস্মিত হই না । এ হল গিয়ে ' মা ' সন্তানের জন্য যতদুর সম্ভব যাবে।
কোটা
-' ইউ আর এস সি?'
পুনমের কটা চোখে কুণ্ঠা ফুটে ওঠে। আত্মগ্লানিতে শরীরটা কুঁকড়ে যায় ।
ভাগ্য ভালো মেয়েটা আর কিছু না বলে বারান্দার দিকে চলে গেল।
কি সুন্দর মাধুরী দিক্ষিত এর মতন চুলের ছাঁট , গেহুয়া রং, জামার কাট | কাপড় দেখলেই বোঝা যায় খুব বড়লোক। কোথা থেকে কেনে কে জানে? পুনম আড়চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। ফোন করছে বারান্দায় হেলান দিয়ে, আঙুলে চুল জড়ানোর অভ্যাস আছে মেয়েটির । কথা বলার কি কায়দা ! তাকিয়ে দেখেই প্রেমে পড়ে যায় পুনম। নিজের সুটকেস টেনে জিনিস গুছোতে গিয়ে দেখে তার বিছানার পাশে অল্প জায়গা আর আলমারিটার পাল্লা ভাঙ্গা । মেয়েটা নিজের জামাকাপড় বিছানায় টাল করে রেখেছে। ওপাশ থেকে ভারী সুন্দর একটা গন্ধ ভেসে আসছে । অচেনা মিষ্টি মন কেমন করা খুশবু।
কলেজে পড়ার সময় প্রেরণা রাও , মুগ্ধা শিন্ডে, ঊর্মি পাতিলরা এক সাথে থাকত । ওদের গায়ে, জামাকাপড়েও এরকম অচেনা গন্ধ । তারা সব আসমানের হুরপরীদের দল । খুব দরকার না পড়লে কখনো কথাই বলে নি। অনেক পরে থার্ড ইয়ারের রেজাল্ট ভালো হল আর ল্যাবে পাশে সিট পড়ত বলে মাঝে মাঝে মুগ্ধা একটা দুটো কথা বলত আর কখনো কখনো ঊর্মির চোখে দেখেছে হাল্কা হাসি।
পুনম সমাজের তলার দিকের মানুষ । ওর মা অঙ্গনওয়াড়ির কর্মী। বাবা সামান্য রাজমিস্ত্রি । তাও ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে বছর খানেক ভুগে মারা যায় । পুনমের বয়স তখন মোটে দশ। নেহাত 'নবচেতনা ' এনজিওর দিদিদের চোখে পড়ে যায় । পুনম আর অরবিন্দ দু ভাইবোন কে ওখানের বড়ী অম্মা এক এরকম দত্তক নিয়ে নেন। সকাল বিকেলে পড়ানো, দাল, চাওল-বাখরি খেতে দেওয়া । পরিবর্তে অবশ্য পুনম আর ওর মা বড়ীঅম্মার সব কাজ করে দিত।
তারা কি নমকহারাম নাকি? ক্লাস টেনে ওঠার আগেই পুনম মনে মনে স্থির করে ফেলে সে ডাক্তার হবে। বারো ক্লাসে বেশ ভালো রেজাল্ট । আর পর এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করে, সিডিউল কাস্ট কোটাতে জলগাঁও এর সরকারি মেডিকল কলেজে ঢুকে পড়ে। গ্রামে সেদিন আনন্দের জোয়ার। অম্মা নিজের হাতে সবাইকে বেসনের লাড্ডু বিতরণ করেন। মায়ের হাতের পিঠলা বাখরি খেয়ে সবাই তাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করে। এবার তাদের দুঃখের দিন শেষ ।
তবে পুনম বোঝেনি তার লড়াই আসলে সেদিন থেকেই শুরু হল। এত দিনের কষ্ট ছিল আসল সিনেমার ট্রেলার।
-' এ কোটা! তেরা র্যাঙ্ক তো বতা ?'
পুনম দের মত এসসি /এসটি দের মুখ চুন।
( চুপ থাকবি। আঁখ নীচে। সহ্য করলেই টিকতে পারবি) অম্মার বলা মন্ত্র মনে মনে জপে। গাঁও এ কোনোদিন নীচু জাত বলে কথা শুনেছে কিনা মনে নাই। বা হয়ত বুঝতেই পারেনি ।আসলে মাথা নীচু করে থাকাটাই অভ্যাস । সেটাই যেন স্বাভাবিক ।
গ্রামের সহজ পরিবেশ থেকে বেরিয়ে শহরের বড়া হাসপাতাল । আংরেজিতে পঢ়াই। অল্প অল্প যেটুকু আংরেজি জানত, তা বলার মতন না । বড়া ঘরের ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা । তাদের খাতা-পত্তর কলম, ব্যাগ এমনকি কলম ধরার কায়দাকানুন অলগ। ক্লাসের কথা বুঝতে পারে না। তার মতন গরিবগুর্বো সাধারণ কোটার বন্ধুরা ক্লাসে কোথায় যে লুকিয়ে থাকে। জিন্দগি ভর পুনম প্রথম বেঞ্চে বসেছে। এখানে ক্লাসে ঢোকার আগেই সে জায়গা হাতছাড়া ।
- মি বৈঠু ?মী ইথে বসু কা?'
সবসময়ই উত্তর আসত - নাহী মাঝা মিত্র ইথে বসলেলা আহে।
খিদে চেপে রাখতে তার কষ্ট নাই। তবে পরিশ্রম করেও পাস না করতে পারার কষ্ট একদম আলাদা। শত চেষ্টাতেও যেন কিছুতেই ছুঁতে পারে না ওদের। ক্লাসে গড়গড়িয়ে বলতে থাকেন স্যার ম্যাডামরা। বুঝতে বুঝতেই বিষয় বদলে যায় । ক্রমশই পিছিয়ে পড়ে পুনম। সাঁতার না জানা মেয়েটাকে সবাই যেন ছুঁড়ে ফেলেছে উত্তাল সমুদ্রে। লাইব্রেরিতে বই নেবার আগেই অন্যেরা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়। চারিদিকের ঘন অন্ধেরা, বুকে সবসময় ভয় ভয় অনুভূতি । জাতের কথা উঠলেই ঘাবড়ে যেত।
-' মী মাঝা কুটুম্বাতীল প্রথম পীঢ়ীতীল বিদ্যার্থী ।'
প্রথম জেনারেশন কলেজ স্টুডেন্ট সে।
মিন মিন করে বলত সে। কি করে বোঝায় তাদেরকে তার পরিবেশ, স্কুল আর তার পারিবারিক অবস্থা। সরকারি কোটা সিসটেম ছিল বলেই না সে আজ পড়তে পারছে। কে জানে কত ভাল ছেলেমেয়েদের জায়গা ছিনিয়ে নিয়েছে। এটা ভাবলেই মরমে মরে যায় তারা। বাড়ির প্রথম কলেজ ছাত্রী হয়ে তার কি এত বড় সৌভাগ্য হওয়া উচিত?
তাদের হস্টেলে আবার ভীষণ জলের কষ্ট । আসলে জলগাঁও খরাপ্রবণ এলাকা। তাই সেখানেও ভাগাভাগি । সিনিয়রদের স্নানের পর তারা বাথরুমে ঢুকতে পারে। সরু জলের ধারা কখন যেন মমতা ত্রিপাঠী, ভোঁসলে, দেশপাণ্ডেদের দলের দখলে চলে যায় । পুনমের ভাগে কোনোদিন চার কোনোদিন পাঁচ মগ জল পড়ে থাকে। তলানির নোংরা জলেই স্নান কাচা সারতে হয়। সুখের কথা সেসব দুঃস্বপ্ন দিন সে পার করে এসেছে। হস্টলের ওয়ার্ডেন দিদি কি ভাবে যেন অম্মাকে পরিচিত ছিলেন। উনি আর থার্ড ইয়ারের মিতাদিদির সাহায্য না পেলে পুনমের স্বপ্ন হয়ত অধরা থেকে যেত । তবে বিনামূল্যে কিছুই মেলে না। সাহায্যের পরিবর্তে মিতা দিদি ওকে দিয়ে গা টেপাতো। অলিভ অয়েল দিয়ে দিদির নরম শরীর ম্যাসাজ করে দিতে হত। লম্বা ,ফর্সা, বয়কাট চুল , প্রখর ব্যাক্তিত্বসমপন্না মিতার পাশে হাঁটতে থাকা কালো, সাদামাটা সালোয়ার কামিজ পরা পুনমের সম্পর্ক নিয়ে সহপাঠীরা হাসাহাসি করত। অগ্নিহোত্রী ম্যাডাম ওকে শেষ দিন অব্দি পছন্দ করলেন না। সব দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করেছে পুনম। সে জানে আর কটা বছর। একবার ডাক্তার হয়ে গেলে সবাই সব ভুলে যাবে। বড়জোর ইন্টার্নশিপ অব্দি তারপর তার মুক্তি। সিডিউল কাস্ট স্টেটাস থেকে মুক্তি, কোটা পদ্ধতির বৈষম্য নিয়ে যারা গজগজ করে তাদের আক্রোশ থেকে মুক্তি , ভয়ঙ্কর দারিদ্র্য থেকে মুক্তি । থার্ড ইয়ারের মাঝামাঝি পড়া অনেকটাই সড়গড় হয়ে আসে। বলতে না পারলেও পড়তে আর লিখতে তেমন অসুবিধা হয় না। প্রজাপতি আস্তে ধীরে গুটি থেকে বের হয় ।
এখন তো সে মুম্বই শহরে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ হবে বলে এসেছে।
তৃতীয় রুমমেটটি এখনো আসে নি মনে হয়। ওদিকের আলমারিটা ভালো। বদলে নেবে নাকি? মাধুরী কে জিজ্ঞেস করলে হয় ? পরক্ষণেই মত পালটে ভাবে সুন্দর বলেই কি ও লিডার নাকি? মনের দৈন্যভাব ঠেলে ভালো আলমারিতে নিজের জিনিস ঢোকাতে থাকে।
মাধুরী দিক্ষিত কানে মোবাইল নিয়ে বলতে থাকে
-' ইট ইস রিডিকুলাস , দে গেট হোয়াটেএভর দে ওয়ান্ট ! আনডিসারভিং ওয়ানস অ্যাস ওয়েল।'
পুনমের কানে সবই আসে। ইচ্ছে করেই জোরে জোরে বলছে মনে হয় ।
-" আমি আনডিসারভিং মোটেই না।"
পুনম মনে মনে বলে উঠল। বুকটা ধুকপুক করে। জন্মগত অভ্যাস । নিজেই নিজের মনকে শাসন করে আর সে মাথা নোয়াবে না।
মাকে ভাইকে খুশ দেখতে চায় সে। টাকা চাই আর চাই তার মান ইজ্জত ।
-' ডক্টর পুনম যাধব , এম ডি , ব্র্যাকেটে লেখা থাকবে গাইনোকলজিস্ট । ওহ্ দিদিয়া কেয়া অ্যাচিভমেন্ট রে!'
' সব হল রে, পর যে থাকলে সবচাইতে খুশি হত সেই থাকল না। ' আঁচলে চোখ মোছে মা।
পুনম যাধব গ্রামের প্রথম মেয়ে ডাক্তার বংশের প্রথম শিক্ষিত । তাকে এই সব গায়ে মাখলে চলবে না।
-" হাই ! আঅ্যাম মহিমা। একচুয়ালি ইউ ডোন্ট লুক লাইক দলিত।"
-" মানে কি ? " পুনম বিস্মিত হয় পড়াশোনা জানা আধুনিক মেয়ের বক্তব্য শুনে।
ক্লাসে আবার সেই এক বিড়ম্বনা । সেই প্রফেসরের বাঁকা
হাসি, তীর্যক মন্তব্য । সহপাঠীদের ছুরি বেঁধানো কথা। সেই ভাইভা তে জেনে বুঝে কম নাম্বার । সেই কথায় কথায় প্রিভিলেজড ক্লাস শোনা । তাই তো সবার এঁটো খাওয়া, মন্দিরে এক কোণে দাঁড়াতে পারা, পুরোনো ছেঁড়া কাপড় পরে বড় হওয়া , প্রিভিলেজ বটে।
মহিমা আর রুষালি তাকে 'সরকারি দুলারি' নাম দিয়েছে। শুনলেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় মন। এমবিবিএস পড়তে আসা পুনম আর মুম্বই এ এম ডি করতে আসা ডাঃ পুনম যাধব কি এক নাকি? রাতের অন্ধকারে মনের স্বপ্ন জ্বলজ্বল করে পথ দেখায়। দিনের আলোয় কঠোর বাস্তবের রুক্ষ জমিতে স্বপ্ন ঠোক্কর খায়। অম্মা বলে এ সব হার্ডল পার করে তাকে ছুটতে হবে।
পুনম যে আর পারে না। হাড়ভাঙা খাটুনির জন্য সে তৈরি কিন্তু তাকে তো কেবল বসিয়ে রেখেছে। সব ব্যাপারেই বৈষম্য । সেদিন স্যার পেশেন্টদের সামনেই বলে দিলেন
-' আপণ হে করূ শকত নাহী, প্লিজ স্টেপ ব্যাক ।' কান তীব্র অপমানে বেগুনি হয়ে যায় । নাক মুখ থেকে আগুনের হল্কা। চোখের জল বাষ্প হয়ে উড়ে গেছে কবেই। সহপাঠীদের দিকে চেয়ে দেখে না সে। তীব্র কম্পিটিশন। সহানুভূতি থাকলেও সবাই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে।
ধৈর্য যেন শেষ হয়ে যায় । এমন দিনে একদিন রোহিতের শেষ চিঠিটা তার চোখে পড়ে। রোহিতের আত্মহত্যা নিয়ে যখন দেশ উত্তাল , পুনম তখন নিজের জীবনযুদ্ধ নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে । রোহিত কে কোনোদিন দেখে নি তবু যেন সে তার আত্মার একটা টুকরো। তার মনের কথা কিভাবে লিখে গেল ছেলেটা ?
" আমার জন্মটাই দুর্ঘটনা । শৈশবের একাকিত্ব থেকে কোনোদিন বের হতে পারিনি। এমনটাও হতে পারে যে আমি দুনিয়াকে বুঝতে ভুল করেছি। প্রেম , বেদনা, জীবন, ও মৃত্যুকে বুঝতে এত তাড়াহুড়ো করার দরকার ছিল না। তবে আমি ভীষন তাড়াহুড়ো করেছি........
...মৃত্যু পরবর্তী গল্পে বিশ্বাস করি না.. না ভূত না আত্মা...
সত্যিই তো এখন জীবনে তার কেবল একটাই লক্ষ্য স্যারের হাত ধরে কাজ শেখা। কিন্তু তাও তো তেমন এগোয় না। অপমান চরম অপমান । বন্ধু, শিক্ষক, কর্মচারী কেউ ছাড়ে না। বাবার মৃত্যু, দারিদ্র্য এটা কি কম পড়েছিল যে ঈশ্বর তাকে রিজার্ভ ক্যাটাগরিতে ফেলে দিলেন।
নাকি উল্টোটা রিজার্ভেশনের সাথে দারিদ্র্য না দিলে চলত না?
রোহিতের মতন সব ছেড়ে ছুড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
- তুমি কি এটিএম থেকে টাকা বের করে দেবে? আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি।
আনমনা পুনম চমকে বৃদ্ধার দিকে চেয়ে দেখে।
- আমার দু হাজার টাকার পেনশন তুলব, বিটিয়া একটু সময় আছে? সাহায্য করবে?
- তুমচে এটিএম কার্ড কোনত্য়াহি ইয়াদ্চ্চিক পিললা দের কা?
- না না যেকোনো লোককে কেন দেব কার্ড ? মুখ দেখি যাকে ভালো মনে হয় তাকেই শুধু বলি ।
বৃদ্ধার সরল উত্তরে পুনমের গলা রুদ্ধ । সে ভালো? তাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়?
টাকা তুলে হস্টেলের দিকে যেতে যেতে পুনম মুঠি শক্ত করে ভাবে এঁদের জন্যই তার পড়া, এত সংগ্রাম । এই যুদ্ধে হেরে রোহিতের মত পালিয়ে গেলে যে তার সাথে সবাই হেরে যাবে। তাকে এই যুদ্ধ জিততেই হবে। তা সে যতই কষ্ট হয় হোক
তে কিতিহি কঠিণ অসলী তরিহী..
(আমার গল্প এখানেই শেষ। আমার ইচ্ছে তাই ঈশ্বরের ইচ্ছের বিরুদ্ধে নায়িকা জিতে যায় । আশার কথা ভাবে। তবে আসল জীবনে পুনমদের কি হয় আমরা সবাই জানি। রোহিত ভেমুলার পরিণতি জানি।)
ফ্ল্যাটমেট
**********
আঠাশ তলায় এমন থ্রি বিএইচকে মহার্ঘ ফ্ল্যাটে আরামে থাকতে পারছি তা কেবল আমার বাল্যবন্ধু বঙ্কুটার জন্য। শালা এখন নামী ফিল্মস্টার কিনা তাই আর ভালো নামটা বলছি না। এখানে এমন ঝিনচ্যাক আয়নার মত মেঝে, কায়দার লিফ্ট , সুগন্ধিমাখা চকচকে প্রতিবেশী, যে মাঝে মাঝে চিমটি কাটতে লাগে বোঝার জন্য যে এটা স্বপ্ন না।
মুশকিল হল রাতে যখনই ফ্ল্যাটে ফিরছি একটা অদ্ভুত গন্ধ ! না না ইঁদুরপঁচা বদগন্ধ না। যেন তীব্র একটা টান। দামী পারফিউম না একদম অন্য রকমের ঘ্রাণ। দরজা খোলার আগেই মদির করে দেয়। গন্ধের উৎস জানতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে মন। এতটা দীর্ঘ পথ পেরিয়ে লিফ্টে ওঠার আগেই পেটটা ফুলে থাকে , হিসি পেয়ে যায়। তাই বাড়িতে ঢোকার ভয়ঙ্কর তাড়া ।
দরজার লক্ টা খুব জটিল। প্রায় দিন গুলিয়ে ফেলি । ঠিক দুবার নাকি তিনবার ঘোরালে টক্ করে খুলে যায়। আজকেও আটকেছে । শালা খোলে আর না।
আরে যাঃ শালা সামনের ফ্ল্যাটের দরজাটা অল্প ফাঁক করা। লাল রাতপোশাকে একটা চারশো চল্লিশ ভোল্ট টেবিলে পা তুলে বসে বই পড়ছে। অবাক কান্ড আগে খেয়াল করিনি তো কোনোদিন ! আমি তো জানি যে এই ফ্লোরের সবকটা ফ্ল্যাট খালি। আহ্ দরজাটা না খুললে এখানেই হয়ে যাবে যে। চাবি ঘুরিয়ে একদৌড়ে বাথরুম। মালটা দরজা খুলে রেখেছে কেন? এ হল হাই সোসাইটি । এখানে সব কিছু বন্ধ দরজার ওপারে হয়। ল্যাচটা বন্ধ করতে গিয়ে বাইরে উঁকি মারলাম সব ভোঁ ভাঁ। 2806 এর দরজা বন্ধ। পেচ্ছাপ পাবেই শালা এমন মোক্ষম টাইমে - নিজের ওপরে এমন রাগ ধরে যায়।
আজকে লোকাল ট্রেন থেকে নেমেই মুতে নিলাম । মনে মনে প্রস্তুত। দরজা খোলার তাড়া নাই। লিফটে উঠতেই সেই গন্ধ। আজকে আরো তীব্র, ঝিম ধরানো নেশার মতন।
শাঁ করে লিফ্ট থামে কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে। নেমেই তাকাই। দরজা যথারীতি বন্ধ। কাঁধের ভারী ল্যাপটপ ব্যাগটা পায়ের কাছে নামিয়ে হতাশ মনে চাবি ঘোরাই। লক খোলার মুহূর্তেই গন্ধটা যেন দশগুণ বেড়ে গেল। কৌতূহলী হয়ে পেছন ফিরতেই হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়!
সে !
আজ পরেছে কালো লেসের ড্রেস!
আঙুরের মতন ফোলা ফোলা ঠোঁট, বড় বড় নিষ্পাপ চোখ , ঘাড় অব্দি অবিন্যস্ত কালো চুল। এ-এ তো আমার ছোটবেলা থেকেই বুকে দোলা লাগানো 'দিব্যা'। মাথাটা টলে গেল । এ কি দেখছি ? কাকে যে কি ভাবছি ? এত ফর্সা ? কি নিটোল হাত- পা, যেন মোম দিয়ে তৈরি পুতুল।
হাসি মুখে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে চোখে চোখ রেখে। তার চোখে, ঠোঁটের মৃদু হাসিতে স্পষ্ট আহ্বান। সম্মোহিত হয়ে এগিয়ে যাব এমন সময় টিং টং শব্দ করে লিফ্ট থামল আমাদের ফ্লোরে।
-" কি রে অভি ? সবে ফিরলি নাকি? চেনা গলা পেয়ে ঘাড় ঘোরালাম।
-" তুই ? এ সময়? পথ ভুলে?"
-" ইয়ার মেরা।" বলে বুকে জড়িয়ে ধরল বঙ্কু।
বঙ্কু আর আমি এক পাড়ার ছেলে। অ্যাক্টিং এর পোকা ছিল , মুম্বই এসে জমিয়ে বসেছে তারপর আমাকেও ডেকে এনেছে । থাকতেও দিয়েছে নিজের স্পেয়ার ফ্ল্যাটে । জ্বালাবে আজকে ব্যাটা। রাতভর ঘুমোতে দেবে না মনে হয়। গলা জড়িয়ে 'ইয়ে দোস্তি ' গাইতে গাইতে ঘরে ঢুকল। হারামজাদা আসার আর টাইম পেলি না ? পিছন ফিরে তাকাবার সময়টুকু দিল না ইডিয়টটা। চলবে এখন সারা রাত হুল্লোড় । মাল খাবে, নাচবে, চিল্লাবে । ভাগ্য ভাল কালকের শুটিং সেকেন্ড শিফটে । এখন মন দিয়ে শুনতে থাকো কোন হারামীর বাচ্চা ডিরেক্টর ওর রোল কেটে দিল। কোন এক্ট্রেস শালা ওয়ান পাইস ফাদার মাদার। কোন রন্ডীর অওলাদ ক্রিটিক ওর নিন্দে করেছে । তারপর চলবে ওর এক্স প্রেমিকা সীমা কে নিয়ে হাহুতাশ।
ঠিক সাতটার সময় দুধের প্যাকেট দরজার সামনে রেখে বেল বাজিয়ে চলে যায়। আজ বার বার বেল বাজাচ্ছে, কি হল রে বাবা ? বাধ্য হয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতেইও হল। কোন সময় হারামজাদাটা পাশে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। সব ঘুমন্ত মানুষের মুখ দেখলে মায়া হয় । আর এ তো বঙ্কা , এক সাথে স্কুল গেছি, কলেজে বিড়ি ফুঁকেছি , এক সাথে টালিগঞ্জের স্টুডিওগুলো তে ঢুঁ মেরেছি। ও হিরো আর আমি টেকনিশিয়ানের কাজ খুঁজেছি।
-" আসছি রে বাবা আসছি। সাত সকালে কি হল টা কি ?"
দরজা খুলতেই দুধ বিলি করে যে ছোকরা তার মুখটা দেখে মটকা গরম। খিস্তি করার আগেই সে বলল
-" সাব আপকে দরওয়াজে পর ইয়ে ব্যাগ। "
-" এ বাবা কালকে ল্যাপটপ ব্যাগটা বাইরেই ছেড়ে গেসল।"
এখানে অবশ্য চুরি হওয়া কঠিন। চারিদিকে সি সি টিভি ক্যামেরার জাল। তবু ছেলেটির ওপর মায়া হল। দাঁড়াতে বলে দুধের প্যাকেট ভেতরে রেখে এসে ছেলেটিকে একশ টাকা দিতে গেলাম।
-" ধন্যবাদ সাহবজী। মালা গরজ নাহী। আমার দরকার নাই।"
সামনের দরজার দিকে চোখ গেল। দরজা বন্ধ।
-" উধার দুধ দিয়া কভি ?"
-" নক্কো" সে পালাবার জন্য অস্থির। মুম্বই ব্যস্ত শহর। এখানে প্রতিটি মুহূর্তের দাম আছে ।
একশ টাকাটা ছোঁ মেরে নিয়ে ছোকরা দুড়দাড় করে চলে গেল ।
বেল বাজিয়ে আলাপ করতে ইচ্ছে করছে। ভদ্র আমি , তা কি আর করা যায়? নির্ঘাত্ কোনো উঠতি নায়িকা বা মডেল। সামনে থাকছে কখনো না কখনো দেখা হবেই। ঘুমটা যখন চটকেই গেছে তখন জিমে যাওয়া যাক্। নীচে রিসেপশনে সন্তোষ বসে। খুব ভালো ছেলেটি ভারী হাসি মুখ।
-" গুড মর্নিং স্যর।"
-" মর্নিং। হাউ আর ইউ।"
-" ফাইন স্যর।"
-" উমম্ সন্তোষ এনি আইডিয়া হু হ্যাজ কাম টু 2806।"
সন্তোষ একটু ভেবে খানিকটা অবাক মুখ করে বলে উঠল
-" স্যর বাট 2806 ডাস নট একজিস্ট। ঐ নম্বরে কোনো ফ্ল্যাটই নাই। 2801 আর 2806 মিলিয়েই তো আপনাদের ফ্ল্যাট। তাই তো আপনাদের তিনটে বেডরুম । আর মাস্টার বেডরুমটা এত বড় !"
আমার মাথা ঘুরে গেল। জিম টিম ভুলে ওপরে দৌড়ালাম। ঠিকই তো ! আমি জানি সন্তোষ ঠিক বলছে। তবে রাতে ওটা কে ছিল ? দিব্যা ভারতী?
সত্যিই দরজাটা খোলা হয় না বহুকাল। ধুলোর দাগ স্পষ্ট। এটা তো আমাদের করিডরে খোলে। এ বাড়িতে ঢোকার দ্বিতীয় এন্ট্রান্স। পর পর দু রাতে কি দেখলাম? ভেতরে গিয়ে দেখি ব্যাটা বঙ্কু আরামে চোখ বুজে শুয়ে। এদিক ওদিক ঘুরে দেখি কোনো দিশা পাই না। বিশ্বাস করতে পারি না এত জীবন্ত ? এত মদ খেলাম নাকি যে হ্যালুসিনেট করব? নাকি সে কেবল আমার কল্পনা? আর সেই অদ্ভুত গন্ধটা?
দিনের আলোয় সব কিছুই ঠিকঠাক লাগে একদম সাদামাটা। বঙ্কুকে ঘটনাটা বলে খামোখা ঠাট্টার পাত্র হতে চাই না। বারোটা নাগাদ বঙ্কুর গাড়ি আগে ওকে বাড়ি ছেড়ে আমাকে শুটিংস্থলে পৌঁছে দিল। এগারোটা অব্দি টানা কাজ। সব গুটিয়ে বাড়ি ফিরতে দেড়টা বেজে গেছে। লিফ্টের বোতামে হাত রাখতেই মনে পড়ে গেল আর বুকের ভিতরটা ধড়াস করে উঠল। শাঁ শাঁ করে উপরের দিকে উঠতে থাকি ।
সাত আট ....চোখ দিয়ে যেন কিছু একটা বলতে চাইছিল।
তেরো চোদ্দ ...আজকেও কি দেখতে পাব ? কুড়ি একুশ ... আতঙ্কে যেন হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সিকিউরিটির ছেলেটাকে সাথে আসতে বললেই হত । আর কিছু করার নেই। কাঙ্ক্ষিত ফ্লোরে ধাতব দরজা নিজে নিজে খুলে যায় । একপা একপা করে এগিয়ে বাইরে উঁকি মারলাম। চট করে একবার বাঁ দিকে তাকিয়ে ডান দিকে তাকালাম। ফাঁকা লবি পর পর আলো জ্বলছে । কেউ কোথাও নেই। ভীষণ ভয় করছে। নিজেই নিজের বুকের ভিতরের লাবডুব লাবডুব শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
সেই চাবি ঘোরানোর কসরত! এদিক ওদিক চেয়ে দেখি। পিছনের দিকে করিডরের নিরীহ বন্ধ দরজা। ভেতরে ঢুকে সুইচ অন করতেই ছড়িয়ে পড়ে স্নিগ্ধ আলো। ছুটে ছুটে বাথরুম, কিচেন, বেডরুমের আলো জ্বেলে দিলাম। ডাইনিং চেয়ারে বসে ধীরে সুস্থে জলের গ্লাস হাতে নিয়ে নিজেকেই জোরে জোরে শোনালাম
-" নেটফ্লিক্সের এই ভুতের সিরিজগুলো দেখাই উচিত না।"
গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে মনে হল ব্যাটা বহুত মাল কামাচ্ছে। এই খাটের গদি যদি এত নরম তাহলে নিজের বেডরুমের খাটটা কেমন কিনেছে কে জানে ? অবচেতনে লুকিয়ে থাকা চিন্তাগুলো ঘুমে জেগে ওঠে। সে কালো গাউন পরে সারা ঘরে ঘুরে বেড়ায়। আমার একটুও ভয় করে না। স্বপ্নের মধ্যেই নিজের ওপরে হাসি পাচ্ছে । জানি তো এ আমার মনের কল্পনা। মুখের উপর দিয়ে চলে যায় নরম আঙ্গুলের পরশ। গায়ে লাগে তার সাটিনের জামার আদর। মিষ্টি গন্ধে মন ভরে ওঠে আর আমি গভীর আবেশে বালিশ আঁকড়ে মুখ গুঁজে দিই নরম বিছানায়।
মোবাইলের আলার্ম বাজলে বাজতেই থাকবে। সাড়ে নটা বাজে। ঘুম থেকে উঠে বিছানায় বসেই সেই মৃদু গন্ধটা নাকে আসতেই চোখের ঘুম উধাও। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে দেখি ভারী পর্দার আড়ালে ঝকঝকে রোদ। এক এক করে আলো নেভাতে থাকি। করিডরের দিকের ছিটকিনি তুলে দিলাম বাবা। কি দরকার এত বড় বাড়ির। যে আছে ওদিকে থাকুকগে সে মনের শান্তিতে ।
কদিনের আউটডোরে কাজ ছিল। শেষের দিন বেশ তাড়াতাড়ি প্যাকঅ্যাপ হয়ে গেল। দশটার আগেই বাড়িতে ঢুকব। আজকে আবার সাথে জুটেছে রাজীব আর শ্রীকান্ত। রাজীব একনাগাড়ে কথা বলতেই থাকে । শ্রী বেশ ভালো রান্না করে। আজ কি খাওয়া যায় এটা নিয়ে দুজনের তুমুল তর্কাতর্কির মাঝে আমরা 2801 এর ভিতরে।
বারান্দার দিকের স্লাইডিং দরজা খুলতেই বাইরের হাওয়া আছড়ে পড়ে ঘরের ভেতরে। আহ্ কি আরাম! বীচের পাশে রাস্তার আলোর মালা, দুরের স্কাই স্ক্র্যাপারের রোশনাই! ঝকঝকে আকাশে একের পর এক প্লেন উড়ে যায় ।ঘরের ভেতরে এ ব্যাটাদের খুনসুটি চলতেই থাকে।
-" তোমরা ঝগড়া করতে থাকো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
বাথরুমে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে ফোয়ারার আরামে সারাদিনের ক্লান্তি যেন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। জল পড়া বন্ধ করতেই মহার্ঘ্য লোশনের গন্ধ ছাপিয়ে নাকে আসে সেই মন আকুল করা তীব্র গন্ধ । বন্ধ দরজার এপারে দাঁড়িয়ে আতঙ্কে হিম হয়ে গেলাম। হঠাৎ করে ভীষণ শীত করে উঠল । কোনোমতে তোয়ালেটা জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছি গরম জলের ভাপে অস্বচ্ছ আয়নায় চোখ যেতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে - লাল জামার আবছা প্রতিবিম্ব !
ঈর্ষার রং নীল
আকাশের দিগন্ত বিস্তৃত উদার নীল নয় , এ হল ঈর্ষার বিষাক্ত ছোবল যা কিনা অপরাজিতার মনের গহন কোণে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে । । এ ব্যথা কারোর কাছে দেখানো যায় না । সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখা ঘা যেখান থেকে অবিরাম টিপ টিপ করে রক্তক্ষরণ হয়েই চলে।
অনিন্দিতাকে কি সুন্দর দেখায় ! পান পাতার মতন মুখ, মায়া জড়ানো কাজলকালো হরিণীর মতন চোখ , দীর্ঘ আঁখিপল্লব, শ্যামলা রং। সব মিলিয়ে একবার ওর দিকে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না । অনির চেয়ে অপরাজিতার রং ঢের ফর্সা । তবুও ছোট থেকেই খেয়াল করেছে সে , পাশাপাশি দু বোন হাঁটলে লোকে অনির দিকেই তাকিয়ে থাকে ।
-" কি মিষ্টি মুখটা।"
অনবরত শুনতে শুনতে অপরাজিতার কান ঝালাপালা । স্কুলেও মায়ের কাছে টিচারেরা বলেন
-" অনিন্দিতা ইজ ব্রিলিয়ান্ট ! "
সর্বত্রই ওর জয়জয়কার । নাচের স্কুলে ভর্তি হল অপরাজিতা । সেখানেও ছোট বলে বোন কেঁদে কেটে ক্লাসে ঢুকে পড়ল। কদিনেই গুরুজি ওর তাকানো, মিষ্টি চেহারা দেখে শেখাতে শুরু করে দিলেন। গরমের ছুটিতে সাঁতার শিখতে গিয়ে সেই এক সমস্যা । সে কাটছে সাঁতার । ওদিকে পাড়ে বসে থাকা মা বাবা , ট্রেনার , ক্লাব কর্মকর্তার দল অনিকে মাথায় তুলে নাচছে।
-' কি সুইট । কি সুইট বাচ্চা । "
ব্যাস হয়ে গেল , সেখানেও সে অনিন্দিতাস্ সিস্টার। অথচ উল্টোটাই হওয়ার কথা। নয় কি ?
রাগ করে এইটে উঠেই নাচ, সাঁতার সব ছেড়ে ছুড়ে বই মুখো। তবে একথা কারুকে বলার না।
বললেই মা বলবে -" ছিঃ এমন ভাবতে আছে?"
বাবা বলে উঠবে -" মনটা বড় করতে হয় অপু। উদার হও।"
মনে মনে মুখ ভ্যাঙায় অপু। গিভিং ,কেয়ারিং মাই ফুট! তবু কি শেষ রক্ষা হয়? তার টুয়েলভে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট আর পাঁচ বছর পর অনির চোখধাঁধানো নাম্বার, খবরের কাগজে ,টিভিতে ইন্টারভিউ । কেন, কেন, কেন ? একই বাবা মায়ের সন্তানের মধ্যে এমন পার্থক্য করে দিলে কেন ঠাকুর? মনে মনে মাথা কুটতে থাকে অপু।
বিয়ের পরেও দেখা গেল অনিন্দিতার স্বামী ভাগ্য তার চেয়ে ঢের ঢের ভালো। জয় অনিকে চোখে হারায় । তাদের খুনসুটি , ভীড়ের মধ্যে চোখে চোখে খেলা, অপরাজিতার বুকটা যেন ফালা ফালা হয়ে যায় । জয় আর অনিন্দিতা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে সহপাঠী ছিল। তারা সমবয়সী। এদিকে অপুর স্বামী সরকারি হোমরাচোমরা । তার থেকে প্রায় ন বছর বড়। তাদের দাম্পত্যে সেই উচ্ছ্বাস নাই। তার আছে সাদামাটা জীবন আর কর্তব্যের দড়িতে বাঁধা ভালবাসার জাল।
এখন অপরাজিতার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু তার একমাত্র পুত্র অঙ্কুর । দ্বিতীয় সন্তান সে ইচ্ছে করেই আনে নি। নিজের বাড়ির ভেতরে ছেলেকে কোন প্রতিযোগিতার মাঝে ফেলবে না।
অনিন্দিতা আর জয় দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায় । লাফিয়ে লাফিয়ে সাফল্যের সিঁড়ি ভাঙে । মাঝে মাঝেই কলকাতা এসে বোনপোকে উপহারে ঢেকে দিয়ে যায় । অপরাজিতা তার ব্যাঙ্কের টাকা গোনার চাকরিকে মনে প্রাণে ঘেন্না করে।
-" দিদি আমরা এবার বাচ্চা আনব বলে ঠিক করেছি।"
ফোনে অনির গলা শুনেই অপরাজিতা র বুকটা ধক্ করে ওঠে।
ঈর্ষার বিষ কুরে কুরে খায় ভিতরটা । মেয়ে, মেয়ে দিও হে ঠাকুর অনিটাকে। ছেলে দিও না।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই এক সকালে অনির ছেলে হবার খবর এল । অপরাজিতার মুখে এক পোঁচ কালি। ঈশ্বর কোনোদিন তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন নাকি ?
বিরস বদনে নার্সিংহোমের দিকে রওনা দেয় অপু। উপচে পড়া চোখের জল লুকোনোর আর্ট সে ভালোই জানে। ট্যাক্সিতেই চুল আঁচড়ে, মুখোশ পরে তৈরি হয়ে নিল।
গেটের মুখেই জয় আর বাবার সাথে দেখা। দুজনেরই ঝুলে পড়া মুখ । জয়ের গালে স্পষ্ট জলের দাগ।
-" বাবা ! কিইইই ?" অপরাজিতা উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চায় ।
-" অনির বাচ্চাটা ঠিক সুস্থ না রে অপা। ওকে ইনকিউবেটরে রেখেছে।"
ঠিক যেন বোধগম্য হল না ব্যাপার টা।
-" সিরিয়াস কিছু ? ও অমন হয় অনেক বাচ্চাদের । " মনের ভেতরে একটা ঢেউ।
-" না গো দিদি ডাক্তার বললেন এ ঠিক হবার না। জন্মগত ত্রুটি । যত দিন বাঁচবে তত দিন....."
জয়ের ভাঙাচোরা গলা কানেই ঢোকে না। অপরাজিতার হৃদপিন্ড যেন লাফিয়ে বের হয়ে আসবে। ভেতরের রক্তাক্ত ক্ষতে ঠান্ডা প্রলেপ । আহ্ ! জীবনে এই প্রথম বুকের ভিতরটা জুড়িয়ে গেল । মুখোশটা টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিল। তারপর পরিষ্কার জয়ের হাত ধরে অপরাজিতা এগিয়ে চলল বোনকে দেখতে ।
গুগলি
-" কোথায় রে ?"
-" এয়ারপোর্টে ঢুকছি , অসম্ভব ভীড় ! "
-"পাঁচটায় প্লেন এখন বাজে সাড়ে চারটে। পাক্কা মিস করবি ! "
পুজোর সময় বিমানবন্দরে গিজগিজ করছে পরিয়ায়ী বাঙালি যাত্রীদের দল । ভাগ্যিস ওয়েব চেক ইন করা আছে । সুটকেসটা কাউন্টার কোনোমতে ডাম্প করে লোকজনকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে' সিকিউরিটি চেকইন করিয়ে, বাগ ল্যাপটপ সামলে গেটের দিকে অলিম্পিকের স্প্রিন্টারের মতন দৌড় দিলাম ।
-" বন্ধুদের সাথে লাঞ্চ ছিল রে তাতেই দেরি ....." অটোওয়াকে ছুটতে ছুটতে হাঁপাই।
-" সবই চাই তোমার ।"
-" আরে সুহানার এইটিন্থ বার্থডে পার্টি , হ্যাড এ গ্রেট টাইম ।"
-" এখনো হ্যাভিং গ্রেট টাইম, রান বেবি রান, ক্যাচ দ্য প্লেন।"
পুজোতে দিদি ব্যাঙ্গালোর থেকে আর আমি দিল্লি থেকে কলকাতা যাচ্ছি।
পচা শহরটাকে যে কি ভীষণ মিস করি ! আলো ঝলমলে পুজো , বন্ধুবান্ধব, আড্ডা , মায়ের রান্না, রোল, ফুচকা আর যেন তর সইছে না ! ফোনটা কেটে
প্রাণপনে দৌড়াই বোর্ডিং গেটের দিকে ...
"বোর্ডিং ওভার ম্যাম ।" নীলবসনা সুন্দরী ভাবলেশহীন মুখে জানায়।
পায়ের তলাটা যেন ফাঁকা হয়ে গেল। এবার কি হবে?
সাড়ে আট হাজার টাকা জলে গেল !
-"প্লিজ লেট মি বি ইন । প্লিজ প্লিজ ! "
পাজি মেয়েগুলোর মনে একটু মায়াদয়া নাই। মাবাবা কি ভীষণ বকবে ! দুপুরের পার্টিটাই যত নষ্টের গোড়া।
-" ট্রাই ফর দ্য নেক্সট ফ্লাইট। " পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোক পরামর্শ দিলেন।
কটমট করে তাকালাম। বলতে কি পয়সা লাগে? এখন বাবাকে না জানিয়ে এত টাকা কোথায় পাব?
কার্ড সোআইপ করে পেমেন্ট করলে নির্ঘাত মেরেই ফেলবে মা ।
-" দিদিইইই।"
-" মিসড ? " অনুর চিৎকার মোবাইলের ভিতর দিয়ে কানে আছড়ে পড়ে ।
-" হুঁ "
-"জানি তো । টাকার দরকার অমনি দিদিইইই ।" দিদির মুখ ভ্যাঙ্গানো মানসচক্ষে দেখতে পেলাম ।
-" দিদিরে প্লিজ বাবাকে বলিস না । ভীষণ বকবে।"
-" খা খা বকুনি। খাওয়াই উচিত। কত লাগবে ? ইউপিআই করছি। রাখছি। আমার প্লেন ছাড়বে । "
রুমাল দিয়ে চোখ-নাক মুছতে মুছতে বুঝলাম মাই দিদি ইস দ্য বেস্ট। এককথায় বারো হাজার ট্রান্সফার করল ।
টিকিটের ঝামেলা সামলাতে সামলাতে গল্প বানালাম।
-" হ্যালো মা ! এক ভদ্রলোকের সাথে টিকিট এক্সচেঞ্জ করেছি । ওঁনার মেডিক্যাল এমারজেন্সি ছিল কিনা ? পরের ফ্লাইটেই আসছি।"
-" মানেএএ। আমরা যেএএ"
মাকে কথা বাড়ানোর সুযোগ না দিয়ে টুক করে কেটে দিই ফোনটা। অনু অবশ্য টাকার কথা কিছুতেই জানাবে না । প্রবলেম সলভ্ড। এদিক ওদিক ঘুরে কোক আর চিপ্স নিয়ে বসতেই ফোনটা বেজে উঠল । বাবার ফোন ! একসেপ্ট করতেই ভেসে আসে ডিপ ব্যারিটোন -" তোমার পরোপকারের জন্য আমাদের কাশ্মীর-ট্রিপ ক্যানসেল করতে হল। টুরিস্ট সিজন সমস্ত ফ্লাইট বুকড । অনেকদিন ধরেই তোমার মা প্ল্যান করেছিল। সারপ্রাইজ দেব ভেবেছিলাম আমরা। "
কিরণমালা
গ্রীষ্মের দুপুরে জানলার পর্দা টেনে ঘর অন্ধকার করে মেঝেতে জল ঢেলে তাপ কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে মা। বাইরে হুহু করে লু বইছে। রাস্তার ধারে কাঁঠাল গাছ বড় বড় ফল নিয়ে হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোদ এমন যে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ঘরের ভেতরে তেমনিই কষ্টকর। অ্যাসবেসটাসের ছাত থেকে গরম লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে। বাথরুমের কোনে সিমেন্ট এর চৌবাচ্চার জলটাই যা ঠান্ডা। সেই শীতল জল মেঝেতে ফেলে ঘর ঠান্ডা করি আমরা। লংড়া কাকটা প্রায়সময় জানলাতে বসে থাকে। সামনের বট গাছের ডালে ওর বাসা। স্কুল ছুটি। ভরপেট পান্তা খেয়ে মারে আলসতে চোখ বুঁজে আসে। চৌধুরী দের বাড়ি থেকে চেয়ে আনা তিনদিন পুরোনো বাংলা কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া মায়ের আদত। এইসময় বিরক্ত করলে খুব রেগে যাবে। খবর, বিজ্ঞাপন, শোকবার্তা ,খেলার পাতা চেটেপুটে দিদির হাত ঘুরে আমার কাছে কাগজটা আসবে চারটে নাগাদ। আমার বাপু অত সময় লাগে না।দিদি ভালবাসে কেচ্ছা কাহিনী পড়তে। কার বউ খুন হল, কে স্বামীকে ছেড়ে পালালো। এমন চটাকেদার পটাকেদার খবর না থাকলে দিদি সোজা আমাকে দেবে আর আমি খেলার খবরটুকু দেখে দাদাকে পাস করে দিই। দাদা ভী ঝটপট চোখ বুলিয়ে বিকেলে খেলার আগে সাইকেলে করে ফেরত দিয়ে আসে আর পরদিনের টা নিয়ে আসে। কাগজ একেবারে নতুনের মতন রাখতে হবে। একটু মুড়ে গেলে কি অযত্ন হলে ওঁনারা বহুত রাগ করেন। উকিল কিনা খবরের কাগজ লাগে। এক বছরের কাগজ ডেট অনুসারে রাখা থাকে।
আমাদের জায়গাটার নাম বাল্মীকি নগর। নেপালের বর্ডার। আগেকার নাম শুনলে খুব হাসি পাবে - ভৈঁসালোটন। পায়ে হেঁটে নেপাল যেতে লাগে মিনিট পনের। গন্ডক ভ্যালি প্রজেক্ট এর কোয়ার্টার এ থাকি আমরা। ছোট ছোট একতলা বাড়ি। পাশের বাড়ির মিশরাচাচা বড়বাবু। সাত মেয়ের পর একছেলে । সরকারী নোকরী করলে কি হবে সরকারের 'হমদো হমারে দো' শুনবার রত্তিভর ইচ্ছা নাই। একলৌতা লৌন্ডা বলে এই পাঁচ সালেই গনুয়ার অনেক দিমাগ। আঠওয়া সন্তান কিনা তাই ছেলের নাম রেখেছে বাঁকেবিহারি। আর শেষের দিকের বোন অন্নু বিন্নুদের সাথে নাম মিলিয়ে ডাকনাম গন্নু। দাদাজী ওকে ডাকেন কান্হা। মানত করা চুল খোঁপা করে বাঁধা থাকে মাথার ওপরে। সারা দিন খেলছে গিল্লি ডান্ডা, কঞা , নাহয় গাছে চেপে ফল পাড়ছে। এই টিয়াপাখি ধরে আনল বা কুকুরের লেজে টিনের কৌটো বেঁধে দৌড়াচ্ছে। আদরে বাঁদর আর কাকে বলে।
আমরা যখন গরমে চুপচাপ ঘরের কোনে সেঁধিয়ে থাকি তখন মিসরাইন সারা দূপুর বড়ি পাঁপড় রোদে শুকোয়। আলু , সাবু পাঁপড়, বয়াম ভর্তি আচার -মোটা মোটা লাল লঙ্কা , আম ,কটহল।
আধা তৈরি হওয়া আচার খেতে দিদি খুব ভালোবাসে। আমরা সবাই অল্পবিস্তর চুরি করে খাই।
মিশরাইনের আচারের গজব সোয়াদ। আমি গ্যারান্টি দিতে পারি অমনি আধপকা অচার তুমি জিন্দগি তে চেখে দেখো নি। আমাদের বাগানের কটহল দিয়েই আচার বানানো হয়। তেল ঢালার তিন চার দিন পর তক্কে তক্কে থাকতে হয়। যেই চাচী এদিক ওদিক হল সেই ঢক্কন খুলে হাত ঢুকিয়ে তুলে নাও।আর পাশের জন ঝট সে কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলবে। সাবধান একটু এদিক ওদিক হল কি খবরীলাল আন্নু ওর মাকে লাগাবে। চাচী বড়ী গাল দিতে থাকে। আচার নাকি গন্দা বা জুঠা হাতে ছুলে খারাপ হয়ে যায়। আমি দু দুবার মার খেয়েছি চাচীর হাতে। সে কিছু না। দিদির জন্য আমি কিছুও করতে পারি।
দিদি রুণা আমার জেঠতুতো দিদি। জেঠিমা মারা যাবার পর বাবা আমাদের কাছে নিয়ে এসেছে। বড়দা মুজাফ্ফরপুরে জেঠুর সাথে থাকে আর কলেজে পড়ে।
জেঠিমা হরদম ভুগতেন আর তারপর তিনবছর আগে মারা গেলেন। মা দিদিকে আমাদের সাথে রাখা পছন্দ করে না। মুখে তেমন কিছু বলে না কিন্তু আমি দেখেছি যে মা মাছের সবসে ছোট পিস দিদিকে দেয়। মন্দির থেকে একটা লাড্ডু পরসাদ এনে আমাদের বেশি বেশি দিয়ে দিদির মুখে এক চিমটি ফেলে বলে- পরসাদ কণিকা মাত্র ! আমার খুব খারাপ লাগে। আমরা যা করি দিদির সব মানা। হঠাৎ বাইরে বেরোনো মানা। সবার সাথে কথা বলা মানা। আমাদের সাথে গিল্লি ডন্ডা, পিট্টো , কব্ড্ডী খেলা মানা। ফুটবল খেলার তো সওয়াল ওঠে না। দাদার বন্ধু রা এলে দিদি কে ঘরের মধ্যে থাকতে হয়।
মা অনেক রাগ করে তখন -ধিঙ্গী মেয়ে বলে বকে। ধিঙ্গী মানে কি? দাদা তো দিদির চেয়ে এক বছর বড় আর ক্লাস হিসেবে দু ক্লাস উঁচুতে পড়ে। তাহলে দাদা ধিঙ্গি নয় কেন? দিদিটার পড়ালেখায় মন নাই। তাতে কি ? সবার মন থাকবে নাকি? ওর তো মা নেই। ওর বাবা মানে আমার জেঠু একটু কেমন যেন। বাবা সাথে খুব ঝগড়া হয় তা কেন কে জানে ? এখন তো জেঠু আনা জানা ছেড়ে দিয়েছে। ছুটিতে কভী কভার বড়দা আসে। তখন দিদি সবচেয়ে খুশি।
বড়দা অমল খুব লাজুক। একদম কথা বলে না। মোটা মোটা কালো চশমা। দাদা এলে আমরা টাকা নিয়ে নেপাাল যাই ক্যাসেট, টেরিকটের প্যান্টের কাপড়, ছাতা এইসব কিনে আনি। বিদেশি সস্তা জিনিষ কিনতে কত দুর দুর থেকে লোক আসে। ফাউন্টেন পেন, সিগারেট আর ফোল্ডিং ছাতা রকমারি কাঁচি, ইরেসার আরো কত কি বিচিত্র লোভনীয় সামগ্রী। মাঝে মাঝে আমরা ব্যারেজে যাই। ওপর থেকে নদী তে পত্থর ছুড়ে ছুড়ে দেখি কার বাজুতে কত দম !
বাবা জেঠুর ওপরে যত রাগ করুক না কেন বড়দাকে খুব ভালবাসে। খোকা কে দেখলেই বাবা খুশ। আমাদের সব আবদার বড়দার মারফত পুরো হয়। বংশের বড় সন্তান , ঠাকুরদার মত বসান মুখ খোকার জন্যই বোধহয় বাবা জেঠুর সাথে সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছে। জেঠিমার শ্রাদ্ধের পর বাবা- মা র কথা শুনতে পেয়েছি। জেঠু নাকি ছোটবেলা থেকেই বাউন্ডুলে। মন্দির সাধু দেখলেই তাদের সাথে ভিড়ে যায়। একা দিদিকে ফেলে চলে যেতেও নাকি আটকাবে না।
মার এত আপত্তি দিদি আমাদের সাথে থাকে বলে। এদিকে যে দিদি থাকাতে যে মায়ের কত সাহায্য হয় । আটা মেখে রুটি বেলে দেয়, তরকারি কেটে দেয়, সকালে বাসি ঘর ঝাঁট দিয়ে দেয়, মশারি ভাঁজ করে দেয়, কাপড় তুলে গুছিয়ে রাখে। বাড়িতে মেহমান এলে জলখাবার বানিয়ে দেয়। তার বেলা?
দিদি আমাকে খুব ভালোবাসে। গরমের দিনে যখন পাখার হাওয়া গায়ে লাগে না দিদি হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করে দেয়। পিঠে সুড়সুড়ি দিয়ে দেয়। গল্প বলে। আজকাল আমাদের দু ভাইকে বাড়ির কাজ কিছুই করতে হয় না। বিছানা তোলা,বই-খাতা, কাপড় দিদি সব গুছিয়ে রাখে।
রুমালে ফুল তোলে। টেবিলক্লথ এ নকসা ফোঁটায়। মিসরা চাচির মেয়েগুলো দিদির কাছে সেলাইয়ের ফোঁড় তোলা শেখে।
উঠোনে একটা বড় চৌবাচ্চা ভর্তি জল থাকে। আমরা সেখান থেকেই জল তুলে চান পায়খানা সারি।
ঐ জল ভরাটাই দাদা আর আমার কাজ। তবে ইদানীং দিদি আমাকে সেটুকুও করতে দেয় না।
আচ্ছা বল এমন দিদির জন্য নাহয় একটু মিশরাইনের চড় খেলাম তাতে কি বা ক্ষতি ?
দাদাটা টেন ক্লাসে উঠে একটু বেড়েছে। স্কুল পালিয়ে সিনেমা গেছে। হিন্দি সিনেমার ম্যাগাজিন দেখে আমি দেখেছি। মৌকা দেখে একদিন বাবাকে চুগলী করব।
আজকাল আমরা পিট্টো আর ক্রিকেট খেলছি। আমি ,দাদা ,কিসনা, রাজীব ,অনিল, মুকেশ। খেলুড়ের সংখ্যা কম হলে পিট্টো খেলার সময় অন্নু কে নিয়ে নিই। খুব একে বেঁকে ছুটতে পারে মেয়েটা আর হাতের টিপ সাংঘাতিক। দুর থেকে বল তাক করে বল ছুড়ে মারতে পারে। গন্নুটা দুধভাত। গোয়ালাপাড়া থেকে আরো কিছু ছেলে জুটেই যায়। গন্নুকে না খেলতে নিলে চাচী আবার মায়ের কাছে কমপ্লেন করে দেবে।
-"লইকা কে তনি দেখি ববুয়া। ছেলেকে একটু দেখো বাবা। "
পাজী গন্নুর ছিচকাঁদুনে স্বভাবের জন্য কেউ পসন্দ করে না। তাই পিট্টোর নাম করে আমরা ওকে বল দিয়ে খুব পেটাই।
আজকে আমরা আমবগিচা পার করে বড় মাঠে খেলতে যাব। উসখুস উসখুস করছি। বাবা একটা জ্যামিতির গোটা একটা চ্যাপ্টার করতে বলেছে। আমার একদম আঁকা আঁকি ভালো লাগে না। পর পর দুদিন আঁধি তুফান হল। আম বাগিচা থেকে কৈরী মানে কাঁচা আম পকেট ভরে নিয়ে আসব। দিদি সেগুলোর খোসা ছুলে পাতলা পাতলা করে কেটে নুন চিনি লঙ্কার গুঁড়ো মিলিয়ে বড় নীল সাদা চিনেমাটির বাটিতে ঢাকা দিয়ে রাখবে। তারপর বারোটা নাগাদ সবাই মিলে একটু একটু করে চেটে চেটে খেতে দারুণ লাগে।
-এত বাজে খাতাটা দাদা! দেখ না একটাও এঙ্গেল ঠিক মতন আঁকতে পারছি না। সচমুচ পছত্তর ডিগ্রি দুবার মেটাতে হল। বাবা মারবে।
- নাচ না জানে আঙ্গন টেড়া। পারছ না তাই খাতার দোষ। উঁ আঁকো ঠিক করে। নাহলে খেলতে যেতে দেব না। খবরের কাগজ থেকে মুখ না তুলেই মা বললেন।
- করছি অঙ্ক তাতে উঠোনের কথা কোথা থেকে আসে মা ? দে না দাদা বলে কি করতে হবে?
দাদা মোটা একটা বইয়ের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। কিছুতেই সাহায্য করছে না। এইসময় দাদাজী থাকলে কি ভালোই না হতো। দাদাজীর বুক পর্যন্ত সাদা দাড়ি । কানের পাস থেকে নেমে আসা কাঁধ অব্দি সাদা নরম চুল। গাঁধীজির মতন গোল কিন্তু কালো চশমা আধময়লা ধুতি আর খাদির পাঞ্জাবী। ফ্রিডম ফাইটার ভারত ছোড়ো আন্দোলনে জেল হয়েছিল।সদাকত আশ্রমে চলে যান মাঝে মাঝে । যেখানেই থাকেন ওর আশে পাশের লোকেদের মনে আনন্দের ছোঁয়া লাগে। আমাদের গল্প শোনান । পড়া বুঝতে সাহায্য করেন। সবারই প্রিয়। পছন্দের মানুষ। বাবা মিশরাজীকে বেশি পছন্দ করে না কিন্তু ওর বাবা মানে দাদাজীকে খুব শ্রদ্ধা করে। ঠিক কি করলে ফ্রিডম ফাইটার হয় তা আমি বুঝি না। তবে সরকারি লোকেরা পন্দরহ অগস্ত ছব্বিস জনবরী তে দাদাজিকে দিয়ে ঝান্ডা তোলায়।
আন্নুকে শেখান- খুব লড়ী মরদানী ওহ তো ঝাঁসী ওয়ালী রাণী থী।
আমাকে আর গন্নুকে সুর করে জয়শংকর প্রসাদের কবিতা শেখান -হিমাদ্রি তুঙ্গ শৃঙ্গ সে প্রবুদ্ধ শুদ্ধ ভারতী ...
দাদাজীকেই কে ভগবানের মতন মনে করতে করতে অঙ্ক শেষ হল। আজকের পেপারে গাভাসকারের ছবি আছে। দেখলেই মনে হয় কেটে নিই। বড়দা এলে আমরা যদি বীরগঞ্জ যাবার জন্য বাবাকে পটাতে পারি তাহলে একটা 'ভিভ রিচার্ড' আর একটা 'গাভাসকার' এর পোস্টার কিনব আর টাকা বাঁচলে 'পেলে'।
- দাদা যাবি নাকি রে খেলতে ? মোহনওয়া আসবে।
মোহন দাদার বন্ধু। দাদা গেলে আমরা ক্রিকেট খেলতে পারি। দাদা নিয়ম ভালো জানে । তাছাড়া উঁচু ক্লাস বলে ও গোয়ালাদের ছেলেদের কন্ট্রোল করতে পারে। ফেরার সময় সাইকেলে বসে আসা যাবে মন ভাল থাকলে দাদা সাইকেল চালাতেও দিতে পারে। আমি এখন হাফ পায়ডল করতে পারি।
কি পড়ছে কে জানে? আজ এদিক ওদিক একদম তাকাচ্ছে না দাদা। আজ গন্নুকে নিতেই হবে।
হঠাৎ বাইরে চেঁচামেচি, কান্না - অগে মৈয়া গেএএএ। সরু মোটা নানান গলায় কান্নাকাটি শুনে সবাই ধড়ফড় করে বের হলাম। মিশরাইনের দলবল বাইরে। একটা মস্ত ঘোমটার আড়ালে ঢাকা মুখকে জড়িয়ে মিসরা চাচী বুক পিটিয়ে পিটিয়ে কাঁদছে। পিছনে লটবহর পুঁটলি নিয়ে একটা বাচ্চা কোলে লোক আর মুখে আঙ্গুল গুঁজে দাড়িয়ে থাকা আরেকটা উস্কো খুস্কো চেহারার ছেলে কে দেখে মা বলল- ওঃ এতদিনে মিন্নি এল বাপের বাড়ি। দিদিকে দাঁত বের করে হাসতে দেখেই মা খুব গম্ভীর হয়ে আমাদের ভেতরে পাঠিয়ে দিল।
মিশ্রজীর বড় মেয়ে মিন্নিকে গৌনার পর বাপের বাড়ি পাঠায় নি। বেতিয়া পার করে এক গ্রামের সরপঞ্চের ছেলের সাথে মিনিকে বিয়ে দিয়ে ওরা নিশ্চিন্ত। আজ দুটো বাচ্চা নিয়ে সে বাপের বাড়ি এল তাই এই মরাকান্না।
ভেতরে এসে দিদি আর আমার হাসতে হাসতে চোখে জল এসে গেল। মায়ের বকুনিতে হাসির দমক আরো বেড়ে যায়। এ অসুখ সংক্রামক। কখন দেখি মা আর দাদা আমাদের দলে যোগ দিয়েছে। দিদি -আয় হো দদ্দা মেহমান ( জামাই ) অলই বলে মিশরাইনের নকল করছে আর আমরা মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছি, পেট ব্যথা হয়ে গেল ।
শেষে গন্নুকে বাদ দিয়েই দাদা আর আমি খেলতে বেরোলাম। পেপারটা ফেরত দিয়ে মাঠে যাব। উকিলবাবুর বাড়িতে কাগজটা রাখতে গিয়ে বুঝতে পারলাম বেশি চেপে ধরাতে কুঁচকে গেছে। এমনিতেই ওরা আমাকে একদম পছন্দ করেনা | দুবছর আগে বিজয়ার সময় একস্ট্রা জিবে গজা চেয়ে ছিলাম অউর রস হাতে গেলাসটা ধরি তাতেই ঐ জেঠিমা আমার দিকে কেমন করে তাকালেন। এখন স্টীলের বাঁকা গেলাসে আমাকে জল দ্যান।
আজ দাদা বহুত রেগে গেছে আমার ওপরে। আমাকে নামিয়ে বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে একমনে সাইকেলের চেনটা ঠিক করতে লাগল।
আমার খুব ভয় করছে। কি করে যে এরকম করে ফেললাম।হাত দিয়ে সমান করে পেপারটা জায়গা মতো রাখছি। এমন সময় আই বাপ.... জেঠু
-কি রে বিচ্ছু তুই তোর দাদা কই রে ? যেখানে বাঘে ভয় ...
জেঠুকে দেখেই ভয়ে পেচ্ছাপ পেয়ে গেল।
- দাদা বাইরে।
- শোন তোর বাবাকে দেখা করতে বলবি।দরকার আছে।
- হ্যাঁ বলব ।
উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে জেঠু এগোলেন। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। বেঁচে গেলাম মনে হয়।
পরদিনের কাগজটা তুলতেই পিছন থেকে ভারী গলা ভেসে এল।
- শোনো কাগজটা যত্ন করে পড়বে ।
মাথা নীচু করে গোলাপী গোলাপ ঝাড়ের গেটের তলা দিয়ে বের হলাম। মালি এত কি করে সাফ রাখে বাগান ?
আমরা যে কবে নিজেদের পয়সাতে কাগজ কিনে পড়তে পারব?
-দাদা চল বাড়ি গিয়ে আজকেরটা কাগজটা রেখে আসি। মুড়ে না যায়।
- তোর হাতে দেওয়াটাই ভুল হল। দাদা উদাস মুখে সাইকেল চালাতে চালাতে বলল।
মিন্নিদিদি কে পৌঁছতে এসে জীজাজী সাত দিন থাকলেন। কি খাতির ! তেমনি মেহমান নওয়াজী !
একদিন লিট্টী চোখা হল। ভৈসা ঘি তে ডুবোনো সত্তু ভরা লিট্টি । বড় কড়াহিতে ভরে আলু চোখা আর বৈগন ভর্তা। সারাদিন ধরে মাখা গড়া চলছে। বিকেলে মিসরাজি নিজের হাতে গোইঠা মানে ঘুঁটে সাজিয়ে লিট্টি পাকালেন। আর সে লিট্টি চোখা পাড়া ভর্তি লোকে গব গব করে খেল। আমি আর দিদি চোখা নালাতে ফেলে দিলাম। দিদি বলে
-"ছিঃ মিন্নি ছেলের নাক মুছতে মুছতে আলু মেখেছে।"
দুদিন পর নদী থেকে বড় বড় কতলা মাছ বড় সাহবের জীপে করে নিয়ে এল বাবা আর মিসরাচাচা । সেদিন ওরা আমাদের শিলনোড়া চেয়ে নিয়ে গেল। মছলীর সবই ভাল খালি রান্নায় অনেক মসালা লাগে। মিন্নি, গিন্নি, টুন্নি পারি- পারি মানে এক এক করে সবাই তাল তাল সর্ষে ,লাল লঙ্কা, রসুন বাটতে লাগল। চাচী কয়লার উনুন ধরিয়ে উঠোনে সব ব্যাবস্থা করলেন। বঙ্গালী চাচী মানে মা কে রান্নাতে সাহায্য করতেই হল। অত বড় মাছ কুটতে তিন দুই বাড়ির সব পুরুষ মানুষের সাহায্য লাগল এমনকি মেহমানও বাদ গেল না ।
তিনটে মাছ কাটতে বেলা এগারোটা বেজে গেল। আর কি রক্ত কি রক্ত! উঠোনের চৌবাচ্চার জল আদ্ধেক খালি করে মাছ সাফ হল।তারপর পরিষ্কার মাছে নমক হল্দী লাগানো হল । বড় কড়াইতে মা আর দিদি তেল গরম করে মাছ ভাজছে আর বের করতেই সবাই ঝাঁপিয়ে শেষ করে দিচ্ছে। মিসরা চাচা চান টান করে গেঞ্জি আর নীল সাদা চেক লুঙ্গি পরে, খাটিয়াতে আয়েস করে বসে কড়কড়ে মাছ ভাজা খেতে খেতে রায় দিলেন - "মছলী পকাতে মেহনত আছে কিন্তু সোয়াদে বেস্ট। খাইয়ে মেহমানজী খাইয়ে।"
উনুনের আঁচের গরমে মায়ের মুখ লাল। এক তাল লঙ্কা বেটে টুনিয়ার হাত জ্বালা করছে। বেচারি একবার বালতিতে হাত ডোবাচ্ছে একবার ফুঁ দিচ্ছে। দাদা মাছ খায় না। আমিও তেমন একটা ভালো বাসি না। একটা তেল তেল পিস থাকে দিদি জানে | ঠিক রেখে দেবে আমার জন্য। মিসরাইন ঘোমটাতে মুখ ঢেকে এককোণ এ বসে আছে | আর সব তদারক করছে। এত কান্ডর মাঝে গন্নু আর মিন্নির বাচ্চা আটকে রাখাই বিরাট কাজ। অত মাছ নিমেষে উড়ে যেতে লাগল। গন্ধে গন্ধে চৌবেজী তার পাশের বাড়ির কুমার চাচা সবাই এসে হাজির।
মাছ ভাজা সেরে সাড়ে তিনটে নাগাদ ঝোল রান্নার ভার চাচীজীকে দিয়ে মা স্নানে চলে গেল।
- 'কি গো তুমি ঝোলটা রাঁধলেই পারতে।'
বাবার দিকে লাল চোখ করে তাকিয়ে মা মুখ মুছতে মুছতে চলে গেল।
আমি বুঝেছি আজ মা খুব রেগেছে। বেচারী দিদিটা এখনো লেগে আছে ওদের সাথে । মিন্নিদিদি রান্নাঘরে ভাত বসিয়েছে।
খেতে খেতে সন্ধ্যে পার হয়ে গেল। সাতটা নাগাদ ফিল্ম ডিভিসনের আনোয়ার চাচা প্রোজেক্টর স্ক্রীন নিয়ে হাজির। উফ্ফ পুরা খাতিরদারী চলছে। চচার কাছে কুল্যে তিনটে সিনেমা আছে সীতা আউর গীতা , ঘরৌন্দা আর অমর অকবর এন্টনি। আমরা সেই কটাই ঘুরে ফিরে দেখতে থাকি। গেটের সামনে পর্দা লাগল। দলে দলে লোক আসছে|বাচ্চাদের বসান হল সামনের দিকে। মেয়েরা পিছনে। যে যার বাড়ি থেকে কুর্সি এনেছে। তারপর গেট বন্ধ। এবার যার দেখার ইচ্ছে তারা রাস্তায় বসুক। তাতে কোনো অসুবিধা নেই কেবল সব কিছু উল্টো দেখায়। আমাদের সব ডায়লগ মুখস্থ। হিরো হিরোইনের বলছে আমরাও সাথে বলছি। আজ চলছে সীতা গীতা।তাতে আবার চাবুক মারার শব্দটাও কপি হয় -হুস হুস্স | দিদি আর আমাদের পাশে বসতে পারে না । ও সিটি মারতে পারে দারুণ জোরে। কিন্তু মায়ের মারের ভয়ে এখন চুপ করে আছে।
জুলাই মাসের শেষে মেসোমশাই এসেছে মাকে মুজাফ্ফরপুর মাসির বাড়ি নিয়ে যাবে। মাসির ছেলে হবে কিনা তাই| দুবছর আগেও মা গেছিল তিনমাসের জন্য। সেবার অবশ্য আমিও সাথে ছিলাম। একটা দোতলা বাড়িতে মাসিরা থাকত । ঠিক সামনের বাড়িতে অনেকগুলো গরু আর দুটো মহিষ। কি বদবু আর তেমনিই মাছি আর মশা। বাদবাকি বেশ মজা ! স্কুল নেই তাই পড়াশোনাও নেই। তারপর একটা সুন্দর বোন হল রিঙ্কু। কে জানে ঐ বাড়ির দিদাটা রিঙ্কু আসাতে এত রেগে গেল কেন? মাসিকে তো রোজই বকতো আবার মায়ের কাছেও রোজ রেগে হাত নেড়ে নেড়ে কি সব শোনাত। ছোট ছিলাম কিনা তাই তেমন কিছু মনে নেই। তবে এবারে নাকি মাসি কার্তিক ঠাকুরের যজ্ঞের কলা খেয়েছে এবার আমাদের ভাই হবেই হবে। মা গেলেও আমাকে সাথে নেবে না। দিদি তো আছেই বাড়ি সামলে দেবার জন্য । আমিও বড় হয়েছি, উঁচু ক্লাস ফলে স্কুল কামাই চলবে না।
মায়ের মন খারাপ । আমি খুব খুশি। যাক না মা ঐ খিটমিট বুড়ির বাড়ি। আজাদী আমাদের । দিদিও মনে মনে খুশ। সারাদিন টিকির টিকির করার লোক থাকবে না। তবে ভাবি এক হয় আরেক। মা চলে গেলে পরে দিদি খুব চুপচাপ হয়ে গেল। হয় কাঁদছে কিংবা এক কোনে সেলাই করছে।হরবকত গোমড়ামুখ| এ তো উল্টা পাসা একদম তো । মা দিদিকে ভালোবাসে না তাই তো ভাবতাম। দিদিটা বোকা আছে তো খুব| কাকিমাকে মা ভাবে ।
পূর্ণিমার দিন পুরানা শিউমন্দিরে গন্নুর মুন্ডন হবে। আমরা দল বেঁধে যাব।
সবাই বলছে ন্যাড়া হলেই বদমাইশ ছেলেটা নাকি শান্ত হবে। দেখা যাক্।
বিকেলে দিদি রুটি বানাতে বানাতে কাঁদছে। খাবার পরোসতে পরোসতে কাঁদছে।
রান্না ঘরে আসন পেতে খেতে বসেছি আমরা| দাদার স্টিলের থালির সামনে বসে আছে রুটি হাতে |
- "বাবা দিদি কাঁদছে। দ্যাখো না।" বাবা আমার কথা শুনছে না। মন দিয়ে রেডিও তে খবর শোনে আর খায় |
- "ও বাবা! দেখো না। "
- "কি রে কাঁদছিস কেনো রুণা? কোনো ভয় নেই বলেছি তো। " বাবার মুখটা হাসি হাসি।
দিদি আরো জোরে জোরে কাঁদতে লাগল। দাদার মাথা নীচু।
কি ভয় ? কিসের ভয় ? মাঝে মাঝে বড়দের কথা বোঝা যায় না। দাদার মুখটা রাগ রাগ| খাচ্ছে না মোটে|
গন্নুর মুন্ডনের আগের দিন বড়দা এল। দিদি আর বড়দা বাগানের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে কিছু কথা করছে। আমাকে দিল ভাগিয়ে। খানিক পরে দেখি বড়দা মাথা ধরে মাটিতে উবু হয়ে বসে আর দিদি পেয়ারা গাছে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে।
মনে মনে বললাম -" তোর কি হলো রে দিদি ? আমি যখন বড় হব দিদি তোর কোনো কষ্ট থাকতে দেব না। জেঠিমা নেই, জেঠু দেখেনা তাতে কি? আমি তোকে দেখব। অরুণ বরুণ কিরণমালার গল্পের মতন তুই আমার কিরণমালা রে দিদি।"
দুর থেকে দিদির কষ্টে আমার কান্না পেয়ে যায়। মা চলে গেল এখন আরো বেশি দিদির কষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তাহলে মা মনে হয় দিদিকে আসলে ভালই বাসে। বড়দা আর কোনো কথাই বলছে না। দাদা চুপচাপ| মন্দিরেও গেল না আমাদের সাথে। জেঠুই কিছু করে হবে মনে হয়। আমি ছোট কিনা তাই আমার কাছে কিছুই বলে না ওরা।
এর ঠিক সাত দিন পর পর পর দুদিনে দুটো টেলিগ্রাম এর। প্রথমটা আনন্দ সংবাদ মাসির ছেলে হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি দুঃসংবাদ মুজাফ্ফরপুর থেকে বড়দাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাবা মুখ শুকনো করে আমাদের তিন ভাইবোন কে মিসরা চাচী আর দাদাজীর হাতে তুলে দিয়ে চলে গেল।
বাবা বাড়ি থেকে বের হতেই দিদি ঠিক আগের মতন খুশি ছটফটে উচ্ছল। যেন কিছুই হয়নি।
পাঁচ দিন পর বিকেল বেলা বাবা আর জেঠু হাত ধরাধরি করে রিক্সা থেকে নামছে দেখে আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
বাবাদের দেখেই চৌবেজী আর মিশরাজী এগিয়ে গেল। দাদা দৌড়ে গিয়ে থলি আর বাক্সটা তুলে নিল। অজানা আশংকায় আমাদের মুখ চুন। দিদি আর আমি এক অন্যের হাত শক্ত করে ধরে বারান্দায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। কত সময় যে চলে গেল বাবাদের বারান্দা পৌঁছতে।
ওরা আর কিছুই বলল না। রাতের খাবার পড়েই থাকল। আমরা তিন ভাইবোন কাঠ হয়ে বিছানায় বসে থাকলাম। আজ প্রথম আমার মাকে খুব মনে পড়ছিল। দিদির দিকে ভয়ে তাকাতেই পারছি না। বড়দা কি মরে গেল?
আস্তে আস্তে যা শুনলাম তা এক কথায় অসম্ভব মনে হল। আমাদের বড়দার নাকি দিমাগ খারাপ হয়ে গেছে। এখান থেকে ফিরেই ভীষন জ্বর তারপর থেকে ভুল বকছে, কাঁদছে আর জেঠুকে দেখেই চেঁচাচ্ছে। শেষে বাধ্য হয়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। বাবাকে দেখামাত্র বড়দা নাকি বাবার গলা টিপে ধরে। তারপর ওর হাত পা বেঁধে রাখতে হয়। বড়দাকে কাঁকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওখানে নাকি পাগলদের মাথায় শক দেয়।
বড়দাকে একমাস ওখানেই রাখবে|
আমি তো বুঝতেই পারছি না যে ভালো বাড়ির লোক পাগল কি করে হয়ে যাবে ? পাগল তো ননকু -ছেড়া জামা প্যান্ট , নোংরা , দাড়ি-চুল বড় বড় ,গায়ে বদবু সে হল পাগল। লোক কে কামড়াতে আসে। বরগদ পেড়কে নীচে ঘুমিয়ে থাকে । মাটি থেকে কুড়িয়ে কুড়িয়ে খায়|
বড়দা তো আমাদের বড়দা! সাফ সুথরা , কলেজে পড়ে। আমাদের বড়দা তো খুব ভালো।
বড়দা কেন পাগল হবে?
দিদি ওপরে যেন বিজলী পড়েছে । চুপচাপ গুড়িয়ার মতন ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর সব চেয়ে অবাক কথা বাবার সাথে একটাও কথা বলছে না। দাদা আর আমি ভেবে পাচ্ছি না কি হল? মা কবে যে আসবে আর ভালো লাগছে না। আমরা কখনো খাই কখনো এমনিই ভুখা পেট থেকে যাই। আন্নু নাহলে চাচি খাবার রান্না করে আনে বলে -" তনী মনী খা লে বচুয়া"। মিসরা চাচা মাকে ফিরত আসার জন্যে টেলিগ্রাম করেছে।
জেঠু কে আমরা কেউ ভালো বাসি না কিন্তু এখন চুপচাপ বসে একদৃষ্টিতে বরগদ গাছের দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটাকে দেখলেই আমার গলার কাছটা ব্যথা করছে|
'অনেক গুলো ছোটো বাচ্চাদের গলা হাসি শুনে বাইরে বেরোলাম । বাগান পার হয়ে রাস্তায় গিয়ে দেখি অনেক গুলো আধনংগা বাচ্চা হাততালি দিতে দিতে যাচ্ছে। পগলা পগলা শুনে এগোতে দেখি গন্নু দলবল নিয়ে একটা লোককে তাড়া করছে। লোকটার পাজামার একটা পা আছে একটা নেই আর পেছনে লেজের মতন একটা আমুলের দুধের টিন বাঁধা। লোকটা ছুটছে ঘড়ড় ঘড়ড় টিন ছুটছে। লোকটা হাঁটছে খটখট -টিং, খটখট- টিং টিন হাঁটছে। ননকু নাকি? গন্নুকে পরে বকব আগে ননকু কে ধরি।ওকে দাঁড় করাতেই দুর্গন্ধে বমি পেয়ে গেল। পিছন ফিরতেই অবাক এ তো ননকু না বড়দা। কি খারাপ লাগছে দেখতে! ছোটবড় চুল, চশমাটা বেঁকে গেছে। ধরতে গেলাম আর বড়দা রাণুরওওওও রানুওওও বলে ডাকতে ডাকতে নাগালের বাইরে চলে গেল। আমি ছুটছি বড়দাও ছুটছে। এঁকেবেঁকে এঁকেবেঁকে। আমাদের পেছনে পেছনে বাচ্চাদের দল হোওও হোওওও করে আসছে। আমি ছুটছি কিন্তু আমার পা ভারী তাতে বড় বড় ইট বাঁধা।"
ভাইই .... বলে দাদার গলা শোনা যায় দুর থেকে। তারপর ধাক্কা আর ঘুম ভেঙ্গে দেখি এ সব ভয়ানক বুরা সপনা !
দিদি দেওয়াল ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। হাঁটু পার হওয়া লম্বা ঝুলের সাদা ফুল ফুল , ঘটি হাতা বুকে কাছে কুঁচি দেওয়া হলুদ জামা পরা দিদি আর মাথার কাছে দাদা কিরকম করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
সন্ধে বেলা পড়তে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছি |বই খুলে বসেছি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। বার বার টিনের ঘড়ঘড় আওয়াজটা মনে আসছে।
মা ফেরত এসে গেছে।কিন্তু সব কিছু আগের মত না হয়ে যেন আরো গোলমাল। সবাই পত্থরের মত চুপ করে থাকছে। আমরা স্কুল আসি যাই কিন্তু মনের সব আনন্দ শেষ হয়ে গেছে। খেলতে গিয়ে ঝগড়া হল তো গন্নু বলছে
-" তোহরা ভাই পাগল ,হাঁ পাগল! তুম সব পাগল|"
ওমনি আমার খুব রাগ হয়ে গেল। গন্নুর খোঁচা খোঁচা চুলে ভরা মাথাটা দিলাম ঠুকে। এত চিল্লাচ্ছে বন্দরটা। আজ আছে কপালে আমার । কিন্তু আমি আর পরবাহ করি না।
আচ্ছা সবাই জেনে যাচ্ছে কি করে? কে জানে? তবু তো এখনো কেউ বড়দাকে দেখেই নি। আমার বড়দা কি ননকুর মতনই রাস্তায় ঘুমোবে এখন থেকে ? এইটা ভাবলেই তো কান্না পেয়ে যায়|
মা আর দিদিকে আমাদের বাড়িতে রাখবে না । তাই বাবা দিদির বিয়ে ঠিক করছে। আমি বুঝতেই পারছি না এই সবের মাঝে দিদিটা কি করল? মা দিদিকে সেদিন খুব মেরেছে। দিদি খালি খালি বলছে আমি কি করব কাকিমা আমি কিছু করি নি সত্যিই কিছু করি নি। কে যে কি বলছে যে মা এত রেগে আছে? দুর বাবা বড়দের এ সব আমার একদম ভালো লাগে না।
কদিন পরে বাবা আর উকিলবাবু রাঁচি চলে গেল বড়দাকে আনতে। উকিল চৌধুরী জেঠুর অনেক জান পহচান। বিপদের দিনে বাঙালি বাঙালিকে দেখে।
বড়দাকে দেখে আমরা সবাই কেঁদে ফেললাম। গন্নুর মতন ছোট ছোট চুল , আর কি রোগা কি রোগা হয়ে গেছে! এত দুর্বল যে হাঁটতেও পারছে না।
-"গোড়ী খাওয়াও ছেলেকে বৌমা । সকালে বিকেলে গোড়ীর সূপ খাবে এক মাসে তাগড়া হয়ে যাবে।" চৌধুরী জেঠু হিদায়ত দিয়ে চলে গেলেন।
বড়দার পড়ালেখা এ বছরের মতন শেষ হয়ে গেছে। সারাক্ষণ ঝিমোতে থাকে। কথা বলে না। হাসে না। কোনোমতে একটু খায় আর ঘুমিয়ে পড়ে।
জেঠু কাজে চলে গেছে| মাঝে মাঝে আসে দু এক দিনের জন্য | বাবা মা একদম কথা বলেনা |
পঁচিশ বছর পর
অসহায় দিদির চোখের জলের কোনো দাম ছিল না। মাস ছয়েকের মধ্যে পশ্চিম চম্পারনের বেতিয়া থেকে একটু দুরে মাঝারিয়ার রিফিউজি কলোনির একটি দরিদ্র পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র তপনকুমার দাসের সাথে দিদির বিয়ে হয়ে যায়। জামাইবাবু লোক ভালো এবং বেশ উদ্যমী । কিভাবে যেন জামাইবাবু মালদাতে একটা মনিহারী দোকান খোলেন আর দিদি মোটামুটি সুখেই দিন কাটাচ্ছে। বলাই বাহুল্য সে কালেভদ্রে বাপের বাড়ি আসে|
আমার বাবা আর সদ্য কিশোরী দিদির মাঝে কি হয়ে থাকবে তা অভিজ্ঞ পাঠকেরা সহজেই অনুমান করে ফেলেছেন। মায়ের সন্দেহের তীর বরাবরই দিদির দিকে ছিল। স্বাভাবিক সৌন্দর্য যৌবনের ডালি সাজিয়ে বাবাকে প্রলুব্ধ করার দায় যেন অবশ্যই দিদির !
দাদা আমার চেয়ে অনেকটা বড় তাই আমার অনুমান সে সবই বুঝতে পেরেছিল। মিলিটারি তে চাকরি নিয়ে চলে যাবার পর সে বাবা মায়ের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখে নি।
আমাদের সহজ সরল বড়দার মনের যে গভীর ক্ষত হয় তা আর সারে না | আসুরিক চিকিৎসার দাপটে বড়দা কোনো রকমে আরেক বছর বেঁচে থাকে। মুজফ্ফরপুরে এক শীতের রাতে তার মৃত্যু হয়।
আমাদের বাড়ির গোপন কথাটি অরুন, বরুন, কিরনমালার মনের গোপন কুঠুরিতে লুকোনো থাকে |
পরপার
"আশেপাসের লোকেদের দেখি আর ভাবি সিক্সটি পার হয়েই কিরকম এনশেন্ট হয়ে গেলাম। তাহলে একশ পার হলে কি হবে ?
একশ ! একটা শতক বেঁচে থাকা কি রকম ? কত কিছু দেখা হবে। কত কিই না দেখলাম। বলো? "
রিটায়ারমেন্ট এর পরের দিন চা খেতে খেতে বিকাশ রায় স্ত্রীকে বললেন। গতকাল ফেয়ারওয়েল পার্টিতে পাওয়া ফুলগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখেছে মীনা।
"আচ্ছা শেষবার আমাকে ফুল কে গিফ্ট করেছিল বল তো ? "
মীনা নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছে। চিরকাল মীনা কম কথা বলে তবে আজকাল যেন আরো বেশি একা, আরো চুপচাপ। দশটা কথার একটা উত্তর দেবে। এতদিন তার দিকে তাকানোর সময় হয় নি। সব কিছু ঘড়ির কাঁটার সাথে চলত। মাপা কথা নিয়ম মেনে দিনযাপন। চিরকাল বিকাশ সাহেব নিজের জগতে , আর মীনার জগৎ ভিন্ন।
- "দুপুরে কিছু হাল্কা রান্না করবে ? "
-"আজকের রান্না তো হয়ে গেছে। আগে বলতে পারতে।"
-"চলো কোথাও ঘুরে আসি।"
- "কোথায়?"
- "এই এদিক সেদিক।"
- "আজকে তো মায়ার বাড়ি যাবার কথা। ওর একটা অপারেশন হয়েছে।"
- "কই জানিনা তো । "
মায়া মীনার কলেজ জীবনের বন্ধু। কবে আবার কি হল বিকাশের জানা নেই।
দুজনের বয়সে প্রায় এক যুগের তফাত। স্ত্রীকে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াতে দেখে বিকাশ হঠাৎ বুঝতে পারলেন এই নারীকে এতদিন বড় অবহেলায় রেখেছেন। তার বয়স যে এখনো পঞ্চাশ ছোঁয় নি। এখনো সুস্থ সবল, ইচ্ছে করেই চুল কালো করে না মনে হয়। কয়েক গাছি রুপোলি চুলে তার ব্যক্তিত্ব আর সৌন্দর্য বেড়েছে অনেকটা। হাতে পেপার নিয়ে অবাক হয়ে মীণাকে দেখে ভাবলেন সত্যিই কি এই মহিলা তার স্ত্রী ? হালকা সবুজ রঙের তাঁতের শাড়িতে ওকে বেশ মানিয়েছে তো। কতদিন যে ভালো করে তাকিয়েই দেখেন নি।
মীনা সযত্নে একটা লম্বাটে টিপ পরে কানের দুল আটকাতে আটকাতে বলল
- "ফিরতে আটটা বেজেই যাবে। পূর্ণিমাকে বলে রেখেছি চা করে দেবে। রুটির পাত্রটা জলে বসিয়ে রাখতে বোলো বড় পিঁপড়ে হয়েছে ঘরে।"
বিকাশ সাহেব বারান্দার আরাম কেদারায় বসে একফালি আকাশ দেখতে দেখতে নানান ভাবনায় ডুব দিলেন।
খবরের কাগজে কিছুই পড়ার মতন খবর নেই। এডিটোরিয়ালের পাতায় আবার এক আধুনিক লেখকের জ্ঞান। এটা ওটা দেখতে দেখতে কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতেই পারেন না। কলিং বেল আর ফোনের যুগপৎ ধাক্কায় ঘুম ভেঙ্গে যায়। মনে মনে একটু লজ্জায় পড়ে যান বিকাশ। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লেন ! পূর্ণিমাকে দরজা খুলে দিতে দিতে দেখেন ছেলের ফোন।
- "বাবা ! হাউজ লাইফ? এনজয় কর রিটায়ারমেন্ট। মাকে নিয়ে সিনেমা চলে যাও। "
এটা ওটা বলে কাটান ছেলেকে। আসলে ছেলের সাথে একটা দুরত্ব আছে তার। কি যে কথা বলবেন এখন আরো বুঝতে পারেন না। ছেলের ব্যক্তিত্বে তার মায়ের ছাপ। মৃদুভাষী , অথচ দৃঢ়। যা চাই তা অল্প কথায় স্পষ্ট করে বলত। মোটামুটি ভালো ছাত্র ছিল। মীনাই যা দেখাশোনা করার তা করেছে। অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন রাসভারী বিকাশবাবু। বরং ইদানিং ছেলে ফোন করে খবরাখবর নেয়, এটা ওটা বলে।
নাঃ আগামীকাল বেরোতেই হবে। কিছু না হলে লেক কালীবাড়ি হয়ে সাউথ সিটিতে সিনেমা দেখে নেবেন। নতুন করে ভাব জমাতে হবে নিজের স্ত্রীর সাথে।
সাড়ে সাতটা বাজে সময় যেন কাটে না। কখন ফিরবে সে? টিভির রিমোট হাতে বিকাশবাবু আনমনা। একের পর এক চ্যানেল সরে যায় কিছুই যেন মাথায় ঢোকে না।
আটটা নাগাদ মীনা বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে বলে ওঠে
- "একটু দেরি হয়ে গেল । কিছু মনে করো না মায়ার রিপোর্টে কি আছে না জেনে আসতে পারছিলাম না।"
- " ভালো আছে?"
কোনো উত্তর না দিয়ে মীনা বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
- "কালকে একটু সাউথ সিটি যাবে নাকি? কয়েকটা বইয়ের খোঁজ নেব তারপর লাঞ্চ করে বাড়ি ফিরব।" খেতে খেতে স্ত্রীকে বললেন।
-" হঠাৎ?"
- "না এমনিই । চলোই না ? ও কি তুমি একটাই রুটি খেলে?"
- "আমি তো সব দিন একটাই খাই।"
ভুরু কুঁচকে গেল বিকাশবাবু র । সত্যিই কি তাই ! এত কম জানেন তার স্ত্রী সম্পর্কে। আচ্ছা মীনা কি সত্যিই বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিল ?
কিভাবে সময় কাটবে অবসর জীবন? শেষ সাত বছর শহরের বাইরে ছিলেন। রিটায়রমেন্ট এর বছর খানেক আগে থিয়েটার রোডের জোনাল অফিস এ বসতেন। ইদানিং অফিসে ছেলেছোকরাদের ভীড়। অল্প বয়সী দের মাঝে কখনো কখনো যেন হংস মধ্যে বকো যথা। স্বভাব এমন যে কোনোদিনই আগ বাড়িয়ে তেমনভাবে মিশতে পারেন নি।
- "গাড়ি নিয়ে বেরোবে কেন? এই সময়টা স্কুল ছুটির ভীড় থাকে তোমার অসুবিধা হবে। "
- "কেন ? কলকাতা শহর আবার খালি কবে থাকে?
তোমার স্বভাব আর গেল না। আমি যা বলব তোমাকে তার বিপরীতে কথা বলতেই হবে।"
স্ত্রীর যথারীতি কোনো উত্তর নাই। খানিক পরে স্বগতোক্তির মতো বললে-" শরীরটা ঠিক....না গেলেই..."
বিকাশবাবু র ভুরু বাঁকা হয়ে গেল। মুখে বললেন বটে তবে সব দিন প্রতিবাদটা আসলে তিনিই করেন। বাড়ি তার কথাতেই চলে আসছে ।
পথে নেমেই বুঝতে পারলেন মীনা ঠিকই বলেছিল। স্কুল ছুটির বড্ড ভীড়। যোধপুর পার্কের কাছে তাদের ব্যাঙ্কে একটা চেক ফেলতে যাবেন। পার্কিং করাই সমস্যা। একটু আস্তে ধীরে এগোতে হচ্ছে। বাঁ দিকের গলি দিয়ে হুশ হুশ করে গাড়ি আসছে। অসুবিধাটা স্বীকার করা তার পক্ষে অসম্ভব। এমন সময়ে ঠিক পেছনের হাল্কা নীল রংয়ের গাড়িটা ওভারটেক করল।
মীনা একটু উদ্বেগের সাথে তাকিয়ে আছে স্নায়ু টানটান। দুজনের কথাই স্পষ্ট শুনতে পেল সে।
নীল ওপল অ্যাস্ট্রার চালক সঙ্গিনীর সামনে দিয়ে ঝুঁকে জানলার কাছে মুখ এনে চিৎকার করে বলে উঠল
-" সাউথ সিটিতে কমন সেন্স কিনতে পাওয়া যাচ্ছে কিনে নিন।"
মনসংযোগের অভাবে হয়ত, নীল গাড়িটা একটু চেপে দিল দ্রুত স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে গাড়ি সামলালেন বিকাশ। মনে চেপে রাখা বিরক্তি ফুটে বেরোয় হিসহিসিয়ে - "বাস্টার্ড !"
ক্রসিং পার হতেই অ্যাস্ট্রার চালক গাড়ি আড়াআড়ি ভাবে থামিয়ে নেমে পড়ল। লাফিয়ে এসে গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে বলে উঠল -" কি কি বললি?"
তার সাথে উন্মাদের মতন দমাদম কাঁচে ধাক্কা।
মীনা আতঙ্কের সাথে দেখল দরজা খুলে তার স্বামী রাস্তায় নেমে পড়ছেন। ছেলেটি ঝাঁপিয়ে পড়ে এলোপাথাড়ি হাত চালাতে লাগল।স্বাস্থ্যবান বিকাশ এক ঝটকায় ছেলেটির হাত ধরে ফেললেন। মীনা এক ছুটে দুজনকে আলাদা করার চেষ্টা করতে লাগল। ততক্ষণে মেয়েটিও বের হয়ে বিকাশবাবুকে দোষারোপ করে চলেছে। অবিন্যস্ত জামাকাপড়ে অদ্ভুত দেখাচ্ছে মেয়েটিকে।
-" মাগীবাজী করছিস আর গাল দিস। এত সাহস!" প্যাংলা চেহারা তেড়ে তেড়ে ওঠে।"
-" কি বাজে কথা বলছ। উনি আমার হাজব্যান্ড।"
মীনা সবলে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ঝগড়া থামানোর জন্য অনুরোধ জানায়। ছেলেটির চিৎকারের সাথে ফোয়ারার মতন থুথুতে মীনার মুখ গলা ভিজে ওঠে। চারিদিকে লোকের জমায়েত দুই যুযুধান যোদ্ধাকে দেখে বেশ মজা পাচ্ছে । মীনার সকাল থেকেই মাথা দপ দপ করছিল। আর একটা অসোয়াস্তি। বহু কষ্টে বাবা বাছা করে ছেলেটিকে শান্ত করে থামিয়ে সবাই নিজের নিজের গাড়িতে উঠে বসে।
মুখ চোখ থমথমে। কিসের থেকে কি হয়ে গেলো । কান্না চাপতে চাপতে মুখে টিসু ঘষতে থাকে মীনা। একটু এগিয়ে পার্ক করার জায়গা মিলল। দাঁড় করিয়ে গাড়িতে রাখা বোতলের জল গলায় ঢাললেন।
-" তুমি বসবে? আমি ব্যাঙ্কে যাব আর আসব।"
মুখে গলায় টিসু ডলতে ডলতে মীনা যথারীতি নিরুত্তর হয়ে থাকলেন।
-" চাবি থাকল। বসবে না যাবে?" দরজার কাছে দাঁড়িয়ে একবার স্বভাব বিরুদ্ধ আবার প্রশ্ন করলেন বিকাশ।
হেঁটে মোড়ের মুখ অব্দি যেতে , চেকটা জমা দিতে মিনিট পনের লাগল । তারপর ক্রেডিট কার্ড গছাবেই ব্যাঙ্কের দরজার মুখের কাছে দাঁড়ানো ছেলেটি । তার সাথে মিনিট পাঁচেক অনর্থক ব্যায় করতে হল। ফেরার সময় বুঝতে পারলেন বিকাশ, স্ত্রীর কথা না শুনে ঠিক করেন নি। গাড়ি চালানোর অভ্যাসটাই চলে গেছে। দুর্বিনীত ছেলেটির কথা মনে পড়তেই অপমানে মাথা গরম হয়ে গেল। ট্র্যাফিক সিগনাল ভাঙেন নি। কি অভদ্র! ছেলেটি কি নেশাগ্রস্ত? নাকি সময়টাই এমন এসেছে। পাশ কাটানোর মতন জায়গাও তো ছিল। মাথা গরম করে গালাগাল দিলেন বটে তবে আরম্ভ তো ছেলেটি করল। এখনো কব্জির এতটা জোর আছে যে প্যাংলা ছেলেটিকে ছুঁড়ে ফেলতে পারতেন। মীনাকেও বড্ড অপমান করল ছেলেটি। ভাবতে ভাবতে গাড়ির কাছে পৌঁছে দেখলেন মীনা চোখ বুজে সিটে এলিয়ে আছে । কিছু বলা যায় না। সরি বললে বুকের ভিতরে আরাম হত। আজ পর্যন্ত যে বলেন নি। মুখটা দেখে রীতিমত মায়ায় ভিজে গেল মন। বড় অন্যায় করেছেন। আজকে তার কথা না শোনাটা মস্ত ভুল হল।
-" যাবে নাকি? চল কিছু খাবার কিনে বাড়ি ফিরে যাই। "
- " কি হল কি করবে?" গলার স্বর অস্বাভাবিক ভাবে নরম হয়ে এল।
নতুন ভাবে দিন আরম্ভ করবে বলে ভেবেছিলেন যে বিকাশ। গলার কাছটা কিরকম ব্যথার অনুভূতি , গাড়ির চাবিটা ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন । মীনার চোখ বন্ধ, সিটে মাথা হেলানোর ভঙ্গিটা ঠিক স্বাভাবিক মনে হল না। কাঁধে হাত রাখতেই জানলার দিকে এলিয়ে পড়ল শরীরটা। ভয়ে মুহূর্তের জন্য স্থানু হয়ে গেলেন। সম্বিত ফিরতেই কোনোমতে গাড়ি পাশের হাসপাতালে নিয়ে দাঁড় করালেন। নাঃ এমারজেন্সি নাই। হাসপাতালে এমারজেন্সি থাকে না ? খানিক তর্ক বিতর্ক পর গাড়ি ঘুরিয়ে কাছাকাছি অন্য হাসপাতালের দিকে এগোলেন। স্কুল ছুটির সময়। রাস্তা জুড়ে কেবল গাড়ি, বাস আর ছাত্র ছাত্রীদের ভীড়। হর্ন বাজিয়ে কোনো লাভ হচ্ছে না। গাড়ি এগোয় ইঞ্চি ইঞ্চি ধরে। চোখ ফেটে জল আসছে । জীবনে এত অসহায় কখনো বোধ করেন নি । সিগনালে দাঁড়িয়ে ভাবছেন সোজা বাইপাস নেবেন নাকি বাঁদিকে। ভীড় থাকলেও অল্প দুরত্ব তাই বাঁ দিকের রাস্তা নেবেন স্থির করতেই দেখলেন মীনার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। অসপষ্ট গলায় যেন কিছু কথা বলার চেষ্টা করছে সে।
-" কি হল ? কথা বলো! কিছু বলো, আমরা হাসপাতালে যাচ্ছি।" নিজের ঘড়ঘড়ে গলাটা নিজের কানেই অচেনা ঠেকল। ভীড়, সিগন্যাল ট্রাফিক সামলে কোনোমতে টার্নিং এ দাঁড়িয়ে অধৈর্য লাগে। মাথা বার করে ট্রাফিক পুলিশের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে গাড়িটি বিপজ্জনক ভাবে ঘোরান।
স্ট্রেচারে শোয়ানো মীনাকে এমারজেন্সি বেডে শিফ্ট করে পর্দা টেনে দিল। বন্ধ দরজার সামনে বিকাশ সম্পূর্ণ হতভম্ব। একঘন্টা আগেও এমন ভাবেন নি তিনি। কাঁচের দরজার ওপারে কি হচ্ছে বোঝার জো নেই। গম্ভীর মুখে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকতে বেরোতে থাকা হাসপাতালের ডাক্তার , কর্মচারীদলের মাঝে এক ঝলক দেখা গেল মীনার আকাশী নীল সিল্কের শাড়ির পাড় । আকাশী নীল শাড়ি বিছানা ছেড়ে উঠে আসার অপেক্ষায় শান্ত মুখে বসে আছেন সদ্য রিটায়ার্ড বিকাশ রায়।
শীতের শেষে আমাদের শহরতলির মোটামুটি সব বাড়িতেই ফুল। একটা লোক খালি হাতে আসেনি। সন্ধ্যার মধ্যেই মায়ের সমস্ত শরীর সাদা ফুলে ঢেকে গেল। যে আসছে তার হাতেই এক গোছা ফুল। আমাদের বাড়ির ফুলদানিগুলো ঠেসে ভর্তি। জলের বোতল জাগ, মগ ভরে গেছে। শেষে রজনীগন্ধার স্টিক গুলো গাছের গোড়ায় পুঁতে সাজাতে আরম্ভ করলাম। এত এত টাটকা ফুল ফেলে দেওয়া সম্ভব? এক অতি সাধারণ মানুষের মৃতদেহ কে এভাবে সম্মান দেখাতে আমি কখনো দেখি নি।
চোখ ঘুরিয়ে বাবাকে খুঁজে পেলাম না। অনেক আগে দেখেছিলাম পাশের বাড়ির মৃদুলাবউদি বাবাইকে চা দিচ্ছে। তারপর যে কোথায় গেল লোকটা? খোঁচা খোঁচা সাদাকালো দাড়ি, কোটরে ঢুকে আসা চোখ , পুরোনো রংওঠা কালো ফ্রেমের চশমা, অবিন্যস্ত চুলে যেন বেদনার মূর্ত প্রতীক। সত্যি বলতে কি বেঁচে থাকতে বাবাকে সেভাবে মাকে সম্মান জানাতে দেখি নি। আমরাও কি আমাদের আটপৌরে মাকে তেমন মান সম্মান দিতাম?
অমু তো মাকে ছোটবেলা থেকেই অপছন্দ করত । মা ডাইনে যেতে বলে ও চলত বাঁয়ে। বসতে বললেন দাঁড়াবে। এমনটা আর কি। চাটার্ড এর ফার্স্ট পার্ট পাস করেই চাকরি পেল আর আমরা হলাম ওর কাছে একেবারেই এলেবেলে। সেই অমুই কিনা খবরটা শোনামাত্র ডুকরে কেঁদে ভাসালো। আমি হতবাক।
এই তো মাস তিনেক আগেকার কথা, মায়ের স্ট্রোক হয়েছে শুনে উড়ে বাড়ি এল তাও প্রায় আড়াইদিন পর। এসেই প্রথমে হাসপাতালের চয়েস নিয়ে খিটখিট করল। তারপর মাকে কে দেখবে এই নিয়ে নীরুর সাথে তুমুল ঝগড়া করল।
-' মা এইভাবে ছদিন থাকতে পারে অথবা ছমাস অথবা ছ বছর । ডাক্তারের এই কথা শোনামাত্র অমু আর নীরু পরস্পরের দিকে কথার আগুন ছোটালো।
আমিও ততোধিক বিরক্ত। পক্ষাঘাতগ্রস্ত রুগী সামলানো কঠিন। আয়া, ডাক্তার, ওষুধ, ফিজিওর খরচ ভেবেই চুল খাড়া হয়ে যাচ্ছিল। বাবার যৎসামান্য পেনশন। আমার মাইনে টাকায় সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়।
এই বয়সে এইভাবে বেঁচে থাকার মানেই হয়না।
মা দেখি চিরকালই কান্ডজ্ঞানহীন।
এই কটা দিন কমলামাসি বলে যে আয়া দেখাশোনা করছিল, সে অসম্ভব মুখরা আর চতুর। ঝড়ের বেগে রুগীর কাজ সেরে, বাড়ির রান্নাঘরের পাট চুকিয়ে, টিভির পর্দায় চোখ রেখে নীরুর পায়ে তেল ডলে দিত। বিজ্ঞাপনের বিরতিতে ওদের সুখ দুঃখের আলোচনা সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ত। কেমন মায়ের কৃপণ স্বভাবের চোটে নীরুর মন খুলে সংসার করা হল না। গুষ্টির আত্মীয়দের সেবা করতেই ওর যৌবনের শখ আহ্লাদ ঘুচে গেল। তার সাথে কমলামাসির দেখা নানা পেসেন্ট আর তাদের বাড়ির গালগল্প।
-কোরোনার প্রকোপে কত লোক অকালে চলে গেল। অথচ মা দিব্যি শুয়ে আছে।
নীরুর এই হাহুতাশ মা বুঝতে পারত কিনা জানিনা, তবে বাবার কানে যেত নিশ্চয়ই তবে এই নিয়ে তাঁর কোনও বক্তব্য ছিল না। নিজের খাবার, চা টুকু পেলেই খুশি।
আমি এই সব কথার মধ্যে থাকি না। না বৌ, না মা - আমি শালা কারোর ঝামেলাতেই নেই।
ঘরময় বেডসোর, ওষুধ, ফিনাইল মেশানো উৎকট গন্ধ। সকাল বেলা পরিষ্কার করার সময় মায়ের গোঙ্গানি আর কমলা মাসির গজগজানি শুনে বিরক্ত হতাম। সত্যি সত্যিই ছবছর বেঁচে থাকার অভিশাপ নিয়ে এসেছে কিনা ভাবলেই কেমন একটা ক্ষোভ ভেতরে পাক দিত।
আর এই আয়া মাসিটাও দুনম্বরী। এসেছিলি তো রুগীর সেবা করতে। তাহলে বেডসোর হল কেন? আর তোর গাফিলতিতে যখন হল তখন পরিষ্কার করতে এত বিরক্ত হবার কি আছে? অমুটা তো দিব্যি পাঁচ হাজার, দশ হাজার ঠেকিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। যত ভোগান্তি সব আমাদের ঘাড়ে। ছোট ছেলে হয়েই থেকে যাবে আজীবন।
সকাল থেকেই হিক্কার মতন উঠে গেছিল। ডাক্তারকে কল দেওয়া হল দুপুরের দিকে। যতক্ষণ উনি এলেন ততক্ষণে মা শেষ। তারপর কেবল অমুর আসার অপেক্ষা।
তিনমাস ধরে চলতে থাকা একতরফা যুদ্ধ শেষ হল। আমাদের মা যে এত জনপ্রিয় ছিল জানতাম না। জনে জনে লোক এসে মায়ের ভালোমানুষির গল্প শুনিয়ে যায়। মোড়ের মাথায় দাঁড়ানো রিক্সাওয়ালারা একে একে এসে দেখা করে গেল। ফলের দোকানি, আনাজপাতি নিয়ে বসে সেই আধবুড়ো বিহারি লোকটা, রবি- জামাল আরো কিছু মাছওয়ালা। মুড়িওয়ালি বুড়ির আকুল বিলাপ শানাইয়ের করুণ সুরের মতন আমাদের গলিতে বেজে উঠল। ততক্ষণে বরফগলা জল সিড়ি বেয়ে চতুর্দিক কাদা।
বিকেলের দিকে রিক্সা করে পুটানের মা এসে হাজির। মোটা ফ্রেমের চশমার পিছনে মাসিমার চোখের জল লুকানো যাচ্ছিল না। হঠাৎই ছোটবেলার কত কথা মনে পড়ল। আমাদের শীতের পিকনিক, পুজোর সময় কাকিমা আর মায়ের শাড়ি কেনা। একসাথে ব্রত, সত্যনারায়ন পুজোর জোগাড়। তিনবছর আগে পুটানরা বাড়ি বিক্রি করে পাড়া ছেড়ে চলে গেলেও মায়ের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় নি, হুহু কান্নার শব্দ আর ভাঙ্গাচোরা মুখ দেখে সেটা বোঝাই যাচ্ছিল।
পরের দিন ভোরবেলা কাকিমাই কমলামাসিকে সরিয়ে মায়ের হিম শরীর যত্ন করে পরিষ্কার করে দিল। কত দিন পর এমন সময় মায়ের গোঙ্গানি শোনা গেল না। মায়ের সাথে আমাদেরও ছুটি হল। যেন এই টুকু জন্যই আমরা আমোদ আহ্লাদ থেকে বঞ্চিত ছিলাম। এরপর আমাদের সমস্ত বন্ধন শেষ, দায়মুক্ত আমরা।
শববাহক গাড়িতে শুইয়ে নিয়ে যাচ্ছে মাকে তখন শীর্ণকায় মানুষটার কেবল মুখটাই দেখা যায়। ফুলের গন্ধে আমার মাথা ধরে গেছে। অগুরু, ধুপকাঠি, বাসি- টাটকা ফুল মেশানো উগ্র গন্ধ। ড্রাইভারের পাশে বসে কি একটা অসোয়াস্তি। চেনা পথ অচেনা ঠেকে। লোকজন আমাদের দেখে কপালে হাত ঠেকায়।
শ্মশানে ঢুকতেই একদল ছাগল গাড়ি ঘিরে দাঁড়ালো। শুনেছিলাম সেদিন অফিসে, আমাদের জেলা শহরে ছাগলের বড় উপদ্রব। দেখলাম সত্যিই তাই।
পুটানই সৎকারের বামুন জোগাড় করে এনেছিল। অমু আবার ওর সাথে শ্মশানে ঢোকার মুখেই ঝগড়া করে নিল। ফুলের মালার ডাই এককোণে ছুঁড়ে ফেলতে না ফেলতেই ছাগলের দল কচরমচর শব্দ করে গ্যাঁদা আর রজনীগন্ধা খেতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। অতগুলো ছাগলের সমবেত খাওয়ার শব্দে আমার গা গুলিয়ে ওঠে। শালা!
আমি খচ্চর হলে অমুটা আরেক ডিগ্রি উপরে। হঠাৎ করে প্লেনে আর প্রাইভেট গাড়িতে আসতে হয়েছে, তারপর তাই কমলামাসির এই মাসের মাইনেটা দিতে পারবে না এইকথাটা জানানোর জন্য ঠিক এইসময়টাই বেছে নিল।
হঠাৎই চোখে পড়ে বাবা দুরে দাঁড়িয়ে একমনে নাক খুটছে। যেন এই মুহুর্তে এটাই সবথেকে জরুরী সমস্যা । এর পর যেন একটা ঘোরের মধ্যেই সব কাজ সারা হল। ছোটবেলার বন্ধু বাপি, মনা ওরা এই কাজে এক্সপার্ট। সব মিটে গেলে ওদের দু তিন বোতল ওল্ড মংক কিনে দিলেই হবে। লাইন টপকে ওরা মাকে ছয় থেকে দুই নাম্বারে তুলে দিল।
সবাই মিলে ‘বল হরি হরি বোল’ বলতে বলতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠে এলাম। রোগা ক্ষয়া শরীরটাকে লোহার স্ট্রেচার টাতে শোয়ানোর সময় কতদিন পর মায়ের দিকে ভালো করে চেয়ে দেখলাম। মুখটা গোলগাল লাগছে। লাল টিপ, মাথায় টকটকে সিঁদুর। যেন সারাদিন ধরে অনেক কাজ করার পর ঘুমোনোর প্রশান্তি মুখে ফুটে উঠেছে।
কানে ভেসে এল মায়ের কন্ঠস্বর-' সিধু উওও, রাআজা, রাজাআআ। মায়ের একটা নিজস্ব কায়দা ছিল। জৈষ্ঠ সন্তান আমি। আদর মাখা গলায় উকারের ওপর জোর দিয়ে একবার সিধু বলেই মা সুর করে রাজা বলে টেনে টেনে ডাক দিত। এবারের আকারটার ওপরে অনাবশ্যক জোর। আমাকে এইভাবে আর কেউ ডাকে নি আর কেউ ডাকবেও না। বিকট একটা ঘর্ঘর শব্দের সাথে চুল্লির দরজা খুলতেই দেখি ভেতরটা গনগনে লাল। আগুনের শিখা দেখা যায়না তবে সেই তাপ আমরা সবাই অনুভব করি। অন্য লোকের জন্য আসা আর আপনজনকে পুড়তে দেখা এক কি? আমার চোখের সামনে আধাঁর নেমে আসে। গলা ফাটিয়ে ডেকে উঠলাম - মাআআআ।
পুরুষালী সুগন্ধে অমুকে চেনা যায়। পিছন থেকে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রাখল। পরমুহূর্তেই দুই ভাই দেখলাম স্ট্রেচারটা গড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ধকধকে আগুনের মাঝে। মনে হল ছোটবেলার মতন ছুট্টে গিয়ে জাপটে ধরি।
- মা মাগো, থাকো থাকো এখানেই। আমাদের ছেড়ে যেওনা।
ততক্ষণে স্ট্রেচারটা আরো উজ্জ্বল, আরো দ্যুতিময়। সশব্দে শাটার নেমে আসে, এরপর পঁয়তাল্লিশ মিনিটের অনন্তকালের প্রতীক্ষা । একটা ঘাম তেল মেশানো গন্ধমাখা আঁচল আমাদের যেন ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘুরে বেড়ায়। অমু আর আমি পাশাপাশি বসে থাকি কতবছর পর। সিনেমার মতন ছোটবেলাটা চোখের সামনে দিয়ে পার হয়ে যায়। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে তিনমাস আগের কুৎসিত কথাকাটাকাটি আজ অর্থহীন। অমু যে বেশ ভালো আছে তা ওর পোষাক আসাকে দেখা যায়। আমাদের সামাজিক বৈষম্য বড়ই প্রকট। তবে স্বার্থপরতায় আমরা দুজনেই কোথাও এক। দুর থেকে হৈচৈ ভেসে আসে। শ্মশানের অন্য প্রান্তে দুটো কাঠের চিতা জ্বলছে। মনটা শূন্য। জাগতিক কোনো চিন্তা সেখানে ঘাই মারে না।
নিয়মভঙ্গের রাতে বাড়ি ফাঁকা। অমুরা পরদিন চলে যাবে। অমুর ছেলেটা বেশ হয়েছে। সারাদিন কলকল করে বাড়ি মাতিয়ে রাখে।
সকালের বেঁচে থাকা খাবারগুলো গরম করে খেতে দিচ্ছে কমলামাসি। কাল থেকে ও আর আসছে না। এরপর হয়ত নিরু মা না থাকার কষ্ট অনুভব করবে। মায়ের অসুখের দিনগুলোতে বাড়ির কাজে জন্য কমলামাসি ছিল।
বাবাকে ডাকতে গিয়ে দেখি মায়ের রংচটা আলমারিটা হাটখোলা। সামনে বসে বাবা রাজ্যের জিনিস পত্র ঘাঁটছে। বাবা যেন আরো বৃদ্ধ, ন্যুব্জ। মানুষটা যে সত্যিই আর নেই এটা মেনে নিতে পারছে না। আচ্ছা বাবা কী ভেবেছিল মা ভালো হয়ে আবার আগের মতন বাড়ির কাজকর্ম আরম্ভ করবে? চা দাও, বলে হুকুম জারি করলে লগবগিয়ে চা হাতে হেঁটে আসবে?
কেমন একটা মায়া লাগল। মানুষটা চিরকালই এমন আত্মকেন্দ্রিক ছিল। মা থাকাকালীন তবু একটা জোর খাটানোনোর জায়গা ছিল। আজ বাবা সত্যিই একা।
পরের রবিবার পাড়ার আড্ডা থেকে ফিরে দেখি সেফ এর ভেতরে রাখা কটা ডায়রি বের করেছে বাবা।
মা ডায়েরি লিখত। আমরা দেখেছি। বাবার অফিসের পুরোনো বাতিল ডায়রিতে পুরোনো বছরের সংখ্যাটা কেটে বড় করে নতুন বছরের সাল লিখে ফেলত। রোজকার কথা না, কখনো কোনো গুরূত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে তা লিখে রাখা। জন্ম মৃত্যুর তারিখ, বিয়ে, অতিথি এইসব টুকটাক। আমরা যেমন ছোটবেলায় দিনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিখতাম তেমনটা না। মায়ের সেই খাতাগুলো যে আবার যত্ন করে সেফে তুলে রাখা আছে এটা দেখে অবাক হলাম।
বাবা খোলা পাতা এগিয়ে বলল- এই দ্যাখ, মৃদু গলা প্রায় শোনাই যায় না।
আলতো হাতে খাতাটা ধরলাম। বলপেনে লেখা অক্ষরগুলো যেন হেসে উঠল। গোটাগোটা বাচ্চাদের মতন হাতের লেখা। সন্তর্পনে পাতায় হাত বোলাই।
- আজ রাজার বিয়ে ঠিক হল। নীরুকে দেখেই লক্ষ্মীমন্ত মনে হয়। ছেলেটাকে দেখে রাখবে এইটুকু প্রার্থনা ঈশ্বরের কাছে।
মনটা হুহু করে উঠল। আমরা দুজনেই কি মায়ের এই আর্তির মান রাখতে পারলাম? শেষ কটা দিন যে কেবল তার মৃত্যুকামনা করেছি। অক্ষরগুলোর উপরে নরম করে অ্যাঙুল বোলাতে মনে হল ঠিক যেন মায়ের শীতল গায়ে হাত পড়ল।
পরের পাতায় বেশ অনেকদিন পরের এন্ট্রি।
নীরু সত্যিই ভারী পয়া। যেদিন থেকে বাড়িতে পা রেখেছে, আমাদের দিন ফিরেছে। অমুটার এমন ভালো বিয়ে হলে আমার ছুটি। পরের পাতায় আংশিক চন্দ্র গ্রহণের দিনক্ষণ লেখা।
আবার খানিক জায়গা ছেড়ে লেখা
'তোমরা আমার ওপর শুধু শুধুই এত রাগ করলে । আমি কি এমনটা বলেছিলাম নাকি?
বহুবচনে লেখা। মানে অনেকেই জড়িত। সেদিন কি হয়েছিল তা আজ আমার মনেই পড়ল না। তোমরা মানে মা কাকে বলতে চাইছে বুঝলাম না। মান-অভিমান , জন্ম-মৃত্যুর তারিখ, আবার কোথাও সাধারণ জিনিসপত্রের খরচের হিসেব। মাঝে মধ্যেই দু এক লাইন হিট বাংলা-হিন্দি গানের কলি।
অন্য একটা পুরোনো খাতা তুলে দেখি তাতে টুকিটাকি খরচর হিসেব, মেজ দাদুর শ্রাদ্ধের তারিখ, দুধের দাম এটাওটা লেখা। গোটা ছয়েক খাতা জুড়ে লেখা তেষট্টি বছরের জীবন।
দেওয়াল ঘড়ির এগারোটা বাজার শব্দে বাস্তবে ফিরি। ডাইনিং রুম থেকে নিরুর গলা ভেসে আসে।
-খেতে এসো।
মা থাকতে আমরা ঠিক সাড়ে নটায় খেতে বসতাম। আজকাল সিরিয়াল দেখে দশটার আগে নীরু রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় না।
এতদিনে বুঝি নীরু ঠিকঠাক গৃহকর্ত্রী হল।
ছোটগল্প- ১৪
"ভালোবাসা কারে কয়?"
পাড়ার বুড়োকাকুর বিয়ের কথা আজও স্পষ্ট মনে আছে। তখন আমরা নেহাতই ছোট তাই বুড়ো নামের লোকটার বউ বুড়ি কিনা সেটা নিয়ে ভীষন কৌতূহলী হয়ে পড়েছিলাম। দেখলাম লাল বেনারসি শাড়ি পরা , ছোট-ছোট ঝকঝকে চোখ আর কোঁকড়া চুল, হাসি মাখা লাল ঠোঁট। বউয়ের নাম বাবলি।
বরযাত্রীরদল ভীষণ হাসাহাসি করছিল কারণ বাবলি কাকিমা নাকি বাসরঘরে গান গেয়ে শোনায় -'
সখী তোমরা যে বল দিবস রজনী ভালবাসা ভালবাসা ,সখী ভালবাসা কারে কয়?'
পাড়ার গুরুজনেরা একবাক্যে বউকে বেহায়া স্ট্যাম্প মেরে দিল। বেহায়াপনার আরো নমুনা দেখা গেল যখন কাকিমা বুড়ো কাকুকে অফিস যাবার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে টাটা করতে লাগল। তবে কাকু মাস ছয়েকের মধ্যে একখানা স্কুটার কিনে ফেলে তার চেয়ে ঢের ঢের নির্লজ্জ কাজ করে মুখ কালো করল পাড়ার লোকের কাছে। পাড়ার রকে বসে থাকা যত সব বদ বুড়ো, বেকার ছুড়ো আর দুপুরে রোদ পোয়ানো আড্ডার হিট সাবজেক্ট হয়ে উঠল এই প্রেমিক দম্পতি।
*
বছর তিরিশ পর ছেড়ে আসা ভগ্নপ্রায় পৈতৃক বসতবাটি বেচতে এসে, বুড়োকাকুর চিল চিৎকার শুনতে পেলাম
- "কিইইইই বললি মাগী? তবে এই ছিল তোর মনে?"
- "এত বছর ঘর করছি এখনো তোর মনে সন্দ ? গুয়ের পোকা ভরা মন । ছোটলোক একেবারে।" এইবার কাকীর গলা।
ছেলেবেলার আমাদের মফস্বলের একমাত্র এবং আইডিয়াল রোল মডেল এই দুরবস্থা জেনে মনটা দমে গেল। বিক্রিবাটার পাট চুকিয়ে চলে আসার পথে দেখা করতে গিয়ে দেখি, কাকুরও বাড়ির অবস্থা জীর্ণ।
উঠোন পার করে রান্নাঘরে কাকিমা কিছু রান্না করছে। ফোড়নের সুগন্ধে ম ম করছে চাদ্দিক। আমাকে দেখেই এগিয়ে এল খুন্তি হাতে ,তারপর কাঁচা-পাকা চুল, চশমা চোখে, বিষন্ন হাসি বললে -" খেয়ে যাস কিন্তু।"
-"কি রাঁধছ?"
-"ঐ যে তোর কাকুর পছন্দের রুই মাছের মাথা দিয়ে ডাল, পটল পোস্ত, আর দই মাছ। তুই খেলে বাড়ির গাছের আমড়ার টক করব।
খেতে বসে দেখছি বুড়ো কাকুটা সত্যিই বুড়ো হয়ে গেছে। ডালটা মুখে দিয়েই বলল -
"থু থু কি রাঁধছ আজকাল। মুখে দেওয়াই যায় না। আলুনি। বিস্বাদ। "
আমি অবাক হয়ে ভাবি এরাই একদিন রঙ মিলিয়ে জামা পরত। হাতে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটত, কোমর জড়িয়ে বাইকে করে সিনেমা যেত।
আশু বলছিল কাকু নাকি কাকিমাকে সন্দেহ করে। গায়ে হাত তোলে। কাকিমাও কম নয় সেও নাকি দুএক ঘা কসায়। মাথা নীচু করে এক মনে খেতে থাকি।
হঠাৎ রান্নাঘরের দিক থেকে বাসন কোসনের ঝনঝন শব্দ ভেসে এল।
-" নির্ঘাত কালো সাদা বেড়ালটা । আজ ওকে দেখাচ্ছি মজা।"
এই বলে হাতের খুন্তিটা বাগিয়ে, ছুটে যেতে গিয়ে কাকিমা সিঁড়ির পাশে সটান পড়ে গেল।
আমি কিছু বোঝার আগেই কাকু তিড়িং লাফিয়ে কাকিমার পাশে। কোলে মাথাটা তুলে বুকে এঁটো হাত বুলিয়ে সমানে বলে যাচ্ছে -
" বাবলি, ও বাবলি কি হল তোমার ? ওরে ডাক্তার ডাক। ওগো একবার চোখ খুলে চাও।"
তারপর কাঁদতে কাঁদতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল -" ওরে তোর কাকীমার কিছু হলে আমার কি হবে?"
দুলহিন
ডিসেম্বরের শীত। দুপুরের থেকেই ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধ্যে নামতে নামতে বৃষ্টির তেজ বাড়তে থাকে। হাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে শাড়ির আঁচল দিয়েই কানমাথা মুড়ে , গরম শাল দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে অনিতা। এসবেসটাসের চালে টপটপ করে পড়তে থাকা জলের আওয়াজ। আম, তাল গাছের পাতার খসখস করা শব্দের সাথে আতঙ্ক ফিরে আসে।
ঠিক দেড় মাস আগে অনিতার বিয়ে হয়েছে। নতুন বৌকে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হয়। কথা শুনতে হয়, শাশুড়ির কথামতই চলতে হয়, ছেলেবেলা থেকেই এসব শুনে শুনে হদ্দ হয়ে এবাড়িতে এসেছে।
সারাদিন তটস্থ হয়ে থাকে কোনো দোষ হল কিনা। লোকে কিছু বলছে কিনা, সাসুমার মতের বিরুদ্ধে কিছু বলে ফেলল কিনা?
ওর ফৌজি স্বামী রন্জিত, যাকে সবাই জিতুয়া বলে চেনে , বিয়ের দিন পনের পর কাজের জায়গায় চলে গেছে। আগে থেকেই কথা ছিল বিয়ের পর বৌ বছর খানেকের জন্য শ্বশুরবাড়িতেই থাকবে, আদবকায়দা শিখবে, রান্নাবান্না হাত পাকাবে। ওর শাশুড়ি বিমার তাই আর গৌনার জন্য ওরা ফেলে রাখে নি বৌকে। নাহলে ওদের দিকের নিয়ম হল বিয়ের পর বৌ বাপের বাড়িতেই থাকবে। সময় হলে ছেলের বাড়ির লোক এসে ঘটা করে গৌনার অনুষ্ঠান করে লাড্ডু-বরফি, কপড়া-লত্তা লেনদেন করে বৌ নিয়ে যাবে। তার বেলাতেই সব অনাসৃষ্টি। একবারেই বিয়ের সাথে সাথেই বিদাই হয়ে গেল।
ভিটেবাড়ির মধ্যিখানে উঠোন আর একদিকে বারান্দার পর দুটো সিমেন্ট মেঝের পাকা ঘর। আরেক দিকে রান্নাঘর, ভাঁড়ার ঘর,তার লাগোয়া ঠাকুর ঘর। অন্য দিকে কলঘর, পায়খানা। এই রান্নাঘর আর কলঘরের মাঝে জিতুয়ার সদ্য তৈরি বেডরুম। বিয়ের আগে নিজে দাঁড়িয়ে শহর এর মতন 'এ' ক্লাস বেডরুম তৈরি করিয়াছে জিতু। কালো বর্ডার দেওয়া লাল মেঝে। দেওয়ালে সিমেন্টের তাক। এই ঘরের নাম করে ওরা দহেজে দুলাখ টাকা বেশি নিয়েছে। আর উঠোনে টিমটিম বিজলি বল্ব। ঐ নিয়েই কত গরব। ওদের কথা শুনে আর সারল্যে দেখে মনে মনে হাসে অনিতা। ওর দশ বছরের শহর বাস করার অভিজ্ঞতাতেই ও যা দেখেছে তার আধা দেখলেও এই গ্রামের বোকা লোকগুলো অবাক হয়ে যেত।
ঘরের পাশ দিয়েই উঠে গেছে ছাতে যাবার সিঁড়ি। কলঘর থেকে রান্নাঘর জুড়ে এসবেস্টাসের ছাত। রাত দশটার সময় সদর দরজা বন্ধ হবার পর যত ভুতুড়ে কান্ড আরম্ভ হয়। মশমশিয়ে কে যেন হেঁটে বেড়ায় । ছাতে ওঠা নামা করে কারা । অনিতার ছোট্ট দিল ধড়াস ধড়াস করে। জিতুয়ার উষ্ণ বুকের মধ্যে ঢুকে থাকার সময় তেমন আমল দেয় নি । নতুন শরীরের ওমের কাছে ডরভয় ঘেঁষতেই পারে না। এখন একা দরজা বন্ধ করে সিঁটিয়ে ঠায় বসে ভোলেনাথ কে ডাকতে থাকে অনীতা। আরেকদিন দরজার ওপারে ভারী নিশ্বাস শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেছে । মনে হল কোনো বড়কা জানোয়র দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে।
দিনের আলোতে সব ঠিকঠাক। সারাদিন এদের বাড়িতে অনেক কাজ। খেত খলিহান দেখা, মজুর খাটানো, বড় বড় গরুবলদ, গেহু ধানের খেত - এত কাছ থেকে সে 'জিনগীতে' দেখে নি। ওর বাবা শংকর কলকাতা শহরের মস্ত এক ফেলাটের দারোয়ান। রঘুবীর চাচা, সুরজভান, ত্রিবেণী,যাদবজী সবাই পরিবার কাছাকাছি থাকত। ছবছর আগে যাদবজীর মেয়ে বাড়ি থেকে ভেগে অন্য জাতে বিয়ে করল তারপরেই সবাই নিজেদের ঔরত, লড়কীদের সোজা গ্রামে ফেরত পাঠিয়ে দিলো। ওর বয়স তখন সবে এগারো । কলকত্তার স্কুল আর গ্রামের স্কুলে আকাশ পাতাল ফারাক। অনিতা পাড়ার সরকারি বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়ত। বাঙ্গালীদের সাথে থাকত, গল্প করত। হিন্দি তো সে পড়েই নি। গ্রামে এসে ওরা পড়ল মহা বিপাকে। স্কুলে চোস্ত হিন্দি চলে,আর সবার কথ্য ভাষা মগহী। গ্রামের জীবন তো শহর থেকে একেবারেই আলাদা। ছুটিছাটাতে যখন ওরা দশবিশ দিনের জন্য বাড়ি আসত তখন খেলাধূলা আর হৈচৈ করেই দিন কেটে যেত। অতিথির মতন ওপর ওপর থাকা। গ্রামের সমস্যার গভীরে ঢুকতে হত নি।
হিন্দি না জানার ফলে শহর থেকে আসা সবকটা ছেলেমেয়েদের সাথে অনিতাও ফেল করল। যথানিয়মে বছর ঘুরতে ঘুরতে পড়া ছেড়ে বাড়ির কাজে লেগে গেল।
রান্নাবান্না , চাচার ছোট বাচ্চাদের দেখভাল করা, ঝাড়ু বরতন এইসব আর কি।
পনের বছর পার হতেই মেয়ে বর্ষার জলে ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠা ধানগাছের মতন মত লম্বা হয়ে গেল। বিয়াহ না দিলেই না। গুলাবোর বাপের বাড়ির তরফ থেকেই বঢ়িয়া রিশতা খুঁজে পাওয়া গেল। সরকারি নৌকরের দহেজ মোটা। বিশ লাখ চাইছে। ওপর থেকে মোটর সাইকেল, ঘড়ি , দশ তোলা গহনা । তা অসুবিধা নেই। মেয়ের জন্মের মাস থেকেই ওরা দহেজের টাকা জোগাড় করে চলেছে । শংকরের বাবা পোতির বিয়েতে দুলাখ টাকা দেবে বলেছে। দরকারি করে টাকার অঙ্ক পনেরো লাখে নামানো গেল তখন দেরি না করে অগহনের পহলা লগনেই বিয়েটা লাগিয়ে দিল ওরা ।
ঘোড়া চড়ে , ব্যান্ড বাজা নিয়ে বারাত এল। কান ফাটানো বাজি আর গানের মাঝে , জয়মাল এর সময় ঘুঁঘটের ফাঁক থেকে একঝলক দেখেই তার ফৌজি দুল্হা কে ভালবেসে ফেলল অনিতা । তীখা নাক, ফর্সা রং - একদম কলকত্তাতে দেখা মানুষদের মতন। বিয়ের পরের পনেরটা দিন যেন সপনার মতন কেটে যায়। দিনভর বৌকে আগলে রাখে জিতু। গল্প করে, গান গেয়ে শোনায়, দিল্লগী করে। ওদিকে সাস-সসুর শহরী পুতোহু পেয়ে খুব খুশি। ঝুমর ঝুম ঝুম করে বৌ এঘর ওঘর ঘুরে বেড়ায়।
ভোর হতেই ডোমন চৌধরী সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে তাড়ীর রস আনে, সেই রস খেয়ে এদের দিন শুরু । সকালের রসের পর দুপুরের দিকে আরেক খেপ টকটক গন্ধের রস আসে, তার নেশা বেশি। এই এলাকার নারী পুরুষ নির্বিচারে তাড়ী পান করে। তাড়ী হল তাল গাছের রস। মগধ এলাকায় তাড়ীর মহিমা এই কদিনেই অল্প অল্প বুঝতে পারছে অনিতা। 'ফস্সিলের' তাড়ীর স্বাদ কেমন চমৎকার আর কেমন পাহাড়ে বসেও জিতুয়ার বৈশাখের তাড়ীর স্বাদ মনে করে জিভে পানি আসে! কলকত্তাতে ওদের বাড়ির কাছেই চৌমাথায় ঝুড়ি ভর্তি তাল শাঁস নিয়ে বসে থাকা বসে থাকা বুড্ডাটা যে বঙালী 'পাসী' হবে সেটা এখন ও বেশ বুঝেছে। তালেরশাঁস খেতে শক্ত হয়, আর তার তেমন কোনো স্বাদ নাই- 'শহরী' নতুন বৌটার মুখে এমন কথা শুনে সবাই হেসে অস্থির।
সসুর হুক্কা থেকে মুখ সরিয়ে বলে
-জেঠ মাসে নরম নরম 'কোয়া' খেলে নাকি 'বঙ্গালন বহুরিয়া' রসগুল্লা ভুলে যাবে। দেখবে তখন ভর দুপহর ভরতওয়ার পিছে পিছে ছুছুআতে** ফিরবে।
দুলহনিয়াকে নতুন বাইকের পিছনে বসিয়ে গ্রামের রাস্তা পার করে এক চক্কর মেরে ঘুঘনির চাটের সাথে গুপ্তওয়ার বাগানের মন পসন্দ 'বলতাড়'*^ গাছের তাড়ী খাইয়ে আনার দুঃসাহসিক কান্ড করে এল। এরপর ডিউটি জয়েন করতে যাবার দিন আদরে চুমোয় ভরিয়ে, মাসে দুটো চিঠ্ঠি লিখবেই এমন কথা দিয়ে টিনের ট্যাঙ্ক, কম্বল বিছানা হাতে চলে গেল জিতু। ভরতওয়া গরুগাড়িতে জিতুয়াকে বাসে চড়িয়ে দিতে গেল। পুসের সকালে তার নতুন দুল্হাকে গরুর গাড়ির পিছনে পা দুলিয়ে বসে , ডান হাত তুলে টাটা করতে করতে চলে যেতে দেখে অনিতা চোখের জল আটকে রাখার চেষ্টাই করল না। সবাই বলেছে ফৌজীর দুলহনকে আঁসু ফেলতে নাই। যে লোকটার জন্য এই বীহড় দেহাতে এল সেই যদি না থাকে তবে অনিতা কাঁদবে না তো কি করবে ?
বর চলে যাবার পর অনিতার ঘোর কাটল। সসুরালে লোক বলতে সাস আর সসুর। বাকি দুটো মজুর যারা খেতের কাজ করে, ভরতওয়া, যে গাই বলদদের দেখভাল করে। সকালে এসে গোয়াল পরিষ্কার করে দুধ দুয়ে এটা ওটা করে দিয়ে যায়। ভরতকে অলরাউন্ডার বললে কম হয়। গোটা গ্রামে যার বাড়ির দরকার ভরত হাজির। শাকসব্জি লাগায় , পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে মছলি ধরে আনে, চুনকাম করে দেয়, মন্দিরের ফাই ফরমাস খাটে, আবার বাবুজিকে দুপুরের রোদে তেল দলাইমলাই করে দেয়। তার সাস সারাদিন বিছানায় শুয়ে বসেই খবরদারি করে ঘর চালায়। কি অসুখ তা কে জানে? পাসী ডোমন চৌধরীর বিধবা মৌসী বিয়ের কদিন রাতে ওদের বাড়িতেই থাকত। জিতু যাবার পর একদিন ঝগড়া ঝন্ঝট করে চলে গেল। গ্রাম্য ভাষায় তীব্র চিৎকার, গালিগালাজ অনিতা বুঝেই উঠতে পারল না ব্যাপারটা। এর পর থেকে ঘরের সব কাজের ভার বৌয়ের ঘাড়ে পড়ল।
কাঠের আগুনে রান্না করতে গিয়েই অনিতা চুল্হা-চৌকি আর বিয়াহের আসল মানে ধরতে পারল। সসুরাল যে হদ্দ গ্রাম সেটাও এখন বেশ পরিষ্কার বোঝা গেল। কলকত্তা থেকে রফিগঞ্জ এসে ওরা এসে কাঁদত । এখন টেকরী গ্রামে এসে ভাবে এ সে কোথায় এল? এরা সম্পন্ন কিসান, খানপানের অভাব নেই এদের। তবে জীবনযাপন ওর বাপের বাড়ির থেকেও নিম্ন। ছিরিছাঁদ নেই।
রাত হতেই বৃষ্টি বেড়ে গেল। ঝোড়ো হাওয়ায় অন্তর অব্দি কেঁপে যায়। দুপুরেই সাসুমায়ের পিঠেপায়ে সরষে তেল ডলে দিয়েছিল, সেই তখন থেকেই উনি ঘরের দরজা জানলা বন্ধ করে দুটো লেপের তলায় । অকারণেই অনিতার বুক কেন যেন ধকধক করে। লম্ফ জ্বালিয়ে রাখার কায়দাটা কিছুতেই বুঝতে পারে না । জলের শব্দ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক মিলে মনকেমন করে দুলহিনের । নিবু নিবু চুলোর আঁচে রুটি সেঁকতে গিয়ে জিতুর কথা মনে করে কাঁদতে থাকে। কি অদ্ভুত জীবন মা-বাপকে ভুলে কোথাকার কে লোক যাকে কুল্লে সোলহ দিন ঠিক করে দেখেছে কিনা তার জন্য চোখে জল আসে। আদর করে অনিতা কে 'মেরী রানী ' বলে ডেকেছিল লোকটা।
রাতভর কিসের আওয়াজ হয় বাড়িটাতে? 'ভুতাহা' ঘর নাকি ? তাই বা কে বলে দেবে? সারা জীবনের জন্য এই অন্ধেরা জঙ্গলে আটকে গেল সে।
মা বাপের ওপর অভিমানে বুক ভরে যায়। কে কোথায় কার সাথে পালিয়ে বিয়ে করল বলে আর মাত্র সতের বছর বয়সে ওকেই এমন শাস্তি দিল ভগবান। কলকত্তা শহরে কত আলো, দুকান, বিজলি, লোকজন, খানা-পিনা আর কোথায় এই অজপাড়াগাঁ।
গলা খাঁকারি দিয়ে বাবুজী ওদের ধানের পিন্জ হয়ে রাতের তাড়ীখানার আসর সেরে বাড়ি ঢুকলেন। দরজার খিল বন্ধ করে বারান্দার থেকে গলা তুলে বললেন
-দুলহিন খানা লগাও। জাড়ে হড্ডি কেঁপে যায়। এমন ঠান্ডা বহুদিন দেখি নি।
'তাড়ী পিয়াঙ্ক' দের দেখার আগে অনিতা নেশাগ্রশ্ত লোক কেবল টিভির পর্দায় হিন্দি সিনেমায় দেখেছিল। অমিতাভ বচ্চন গাইত - অল্পই খেয়েছে চুরি তো আর করে নি। আসলি নেশা করলে লোক যে কেমন ব্যবহার করে এখন রোজ দেখছে। সকালে ডোমন, ভরত যাকে সবাই ভরতওয়া বলে কেন কে জানে, সব সময়ই চোখ লাল, মুখ থেকে ভকভকিয়ে গন্ধ।
থালায় রুটি,সব্জি সাজিয়ে ঘোমটা ঠিক করতে করতে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল অনিতা । আজীবন সেই ভয়ানক কালো ঠান্ডা রাতের কথা মনে থাকবে তার।
রসোই ঘরের আসনে বসে রোটি, আলু গোবির সব্জি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে প্রৌঢ় সসুর সিয়ারাম চৌধরী জুঠা হাতেই তার দুলহিনকে কাছে টেনে নিল। জবাই করার সময় মুরগীর গর্দন কসাইয়ের শক্ত হাতের তলায় থাকে, তা সে যতই পাখা ঝটপটাক কসাই নিজের কাজ করেই ছাড়ে। নির্মম চাপে পিষে দিয়ে যখন বাবুজী উঠে গেলেন ততক্ষণে অনিতার শরীরের সাথে মনটাও স্তব্ধ হয়ে গেছে।
বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুলহিন এক ছেলের মা। গাঁওয়ের লোকে বলে ছেলে দেখতে একদম বাপদাদার মতন। তীখা নাক, গোরা চিট্টা। বিয়ের পর থেকে জিতুয়ার ছুট্টি মেলে নি। এক সীমান্ত থেকে অন্য সীমান্তে ঘুরে বেড়ায়। সময় পেলে বাবুজির মোবাইলে ফোন করে। আজতক 'তার রানীর' নামে সে তিনটে চিঠি পাঠিয়েছে।
মাঝরাতে জুতোর আওয়াজ, নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে আর ভয় করে না অনিতার । নিঃসংকোচে দরজা খুলে ভূতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ডোমনের মাসি মাসের চার দিন সিয়ারামের কাছে বদলি ডিউটি দিয়ে যায়। কাপড়ের ঢাকা সত্বেও মোটরসাইকেলটাতে ধুলো জমে। মনখারাপের সুনসান দুপুরে কালো গাড়িটাকেই ঝেড়ে মুছে চকচকে করে ফেলে দুলহিন।
*****
** মগহী ভাষায় ছুছুআনার অর্থ বিশেষ প্রয়োজনে এদিক ওদিক ঘোরা)
*^ ( বলতাড় পুরুষ গাছ আর ফলতাড় নারী। বলতাড়ের তাড়ী সুস্বাদু )
পান করার মাপ আলাদা আলাদা চুক্কা, পন্সেরি ইত্যাদি।
দুযুগ আগে এক পাসীর মুখ থেকে শোনা তথ্য। কিছু ভুলভ্রান্তি হলেও হতে পারে।
ব্যভিচারিণী/ পতুরিয়া
আজকে বাড়ি ফেরার তাড়া আছে তাই বোধহয় হিসেবের গন্ডগোল । আমি দেখেছি যেদিন আমার কাজ থাকে বেছে বেছে সেইদিনই প্রকাশজীর নানান কথা মনে পড়ে । ঝড় উঠেছে । গুড়গুড় শব্দের সাথে বিদ্যুত চমকাচ্ছে । ঝটপট টাকা গুনে হিসেব মিলিয়ে ছুটে বের হলাম। বৃষ্টি নামার আগে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে।
হাওয়ার চোটে ছাতা খোলাই কঠিন। শাড়ির আঁচল, চুল বেসামাল । দুবার ছাতা উল্টে গেল। আমগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছাতাটাকে বাগে আনার চেষ্টা করছি এমন সময় দেখি ফুলি শাড়ির কুঁচি তুলে ঘোমটা টেনে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে
-' দিদিইইই অব তু হি কুছ করি।'
-' আবার কি করব রে ?'
আমার এখন বাড়ি ফেরার তাড়া । ফুলির দুঃখের গল্পগাথা শোনার সময় নাই। ফুলি আমাদের ব্যাঙ্কে ঝাড়পোঁছের কাজ করে । ওর বর সুরজ গত দুবছর আগে ডেঙ্গু জ্বরে প্রায় মরেই যাচ্ছিল । সেই থেকে ওই বরের বদলে কাজ করছে । হাসিখুশি বউটার চাউনির মধ্যে কি যেন একটা আছে দেখলেই মায়া লাগে। সবুজ চকচকে টিপ পরা ঝলমলে মেয়েটা ভিজে ভিজে আমার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলেই চলে
-' এ দিইদিই তুম কছু করো। একটা দরখাস লিখে দাও। দেখেছো জমিটা বিক্রি করতে পারব না । বলছে ও জমিনটাই নাকি আমাদের না। আরেএএ আমাদের না মানে ? আমার দশ পুশ্তের জমীন তুমি বললেই হল? খেতি করি নি দুবছর। তাই বলেই কি জমীন অন্য লোকের হলো।'
ফুলির উত্তেজিত কান্নাভেজা গলার মাঝে আসল কথা খুঁজি । জলের বড় বড় ফোঁটা, শোঁ শোঁ হাওয়ায় শব্দ উড়ে যায় । ফুলি অনর্গল উগরে চলে । পাঁচটা ছেলেপুলে, বীমার মরদ, বুড়ি সাস , বুড্ডা সসুর ।এই কটা টাকায় আর তো চলে না। আধা জমীন বেচে ও লইকা কে পড়াতে চায়। এখন বাবুরা বলছে ওর নাকি জমিনের কাগজ নাই। আমাকে নাকি দরখাস্ত লিখে দিতে হবে। ওর ছেলেকে ও কলেজে পড়াবেই । চানস মিলেছে কলেজে পড়ার, ও ছাড়বে না। এখানে থাকলে ওর বাপের মতন সরাবী হবে ।
-' তা কাগজ নাই মানে?' মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে রিক্সা খুঁজি । ঝড়ের দাপটে সব রিক্সা ফেলে পালিয়েছে।
-' এ দিদি সালোসাল পুরানা কাগজ সব ছিঁড়ে গেছে বলছে । আবার থেকে লিখতে হবে তাই টাকা লাগবে । টাকা কোথায় পাব দিদি? ঘুষ দেব না খাবার খাব ? দরখাস লিখে দিলে বড়ী উপকার হয় । মজিসটিরেট সাহিবা এখন আউরত । আপনিও আউরত। আউরতের কথা বুঝতে পারবেন সাহিবা । ' আঁচলের কোণা দিয়ে চোখ মোছে।
-' কি যে বলে চলে বউটা।'
প্রথম যখন এই গঞ্জে আসি প্রায় তখন থেকেই এদের চিনি। জাতে কহার সুরজ তখন আমাদের ব্রাঞ্চ ঝাড়ু দেয়, সাফসফাই করে । সেই একদিন নিজের মাকে আমার কাছে বাড়ির কাজের জন্য আনে । অল্প কদিন আমার বাড়ির কাজ করেছে । তারপর তো ফুলি চলে এল। ফুলির আবার ছেলেদের পড়ানোর খুব শখ। সরকারি সকুলে পড়াচ্ছে । মাঝে মাঝে মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আমার কাজ কর্ম দেখে। মুগ্ধ চোখে আমার কলম ধরা হাতের দিকে চেয়ে থাকে । বড়াবাবু প্রকাশজি কান্যকুব্জ ব্রাহ্মণ । বাড়ি থেকে জল নিয়ে আসেন আর ফুলির এই লেখা পড়া বাতিক দেখলেই রেগে যান। ছেলে টুয়েলভ পাস করেছে। ফুলির ইচ্ছা শহরের বড় কলেজে পড়ুক।
আজকের ঘটনাটা ঠিক ধরতে পারছি না। বার বার রিক্সার ঘন্টি ক্রিং ক্রিং করে বাজাতে থাকলাম। চেনামুখ।
-' বারিশ কমুক, একটু পরে যাবো দিদি।'
-' পাঁচ টাকা বেশি দেবো , চল চল।'
ফুলিকে বিদায় দিয়ে রিক্সায় চড়ে বসি । হঠাৎ নেমেছে তাই প্লাস্টিকের ঢাকা নাই। জলের ছাঁট ছুরির মতন বেঁধে গায়ে-মুখে। ফুলির উত্তেজিত গলা শুনতে পাই।
-' ছাড়ব না। আমার জমিন। আমার হকের জমিন। পরধানজীর কাছে আমিই চলে যাবো। মরদ যদি চুড়ি পরে ঘরে বসে থাকে থাকুক। তহসীলদারের কাছে যাবো। যা পারি করবোওওও।' ঝড়ে ওর কথার খন্ড খন্ড শুনতে পাই। রিক্সার লগবগে ঢাকা শক্ত করে ধরে পিছনে চেয়ে দেখি ফুলিয়া তখনো মাঝরাস্তায় দু পা ফাঁক করে আমার দিকে তাকিয়ে । শাড়ি ফুলে উঠেছে কিন্তু মাথার আঁচল ঠিক দাঁতে চেপে, একহাত দিয়ে ধরা ।
ফুলির উত্তেজিত গলা বাড়ি অব্দি ধাওয়া করল। মনে হয় রেজিস্ট্রি অফিসের কম্পিউটারে ওর জমির রেকর্ড তোলেই নি। এরকম আরো একজনের শুনেছিলাম মনে পড়ে। তারা টাকাপয়সা দিয়ে কাগজ ঠিক করে ফেলেছিল। ফুলির ঘটনাটাও এরকমই কিছু একটা হবে।
নতুন দিনের নতুন নতুন সমস্যা । ফুলিয়া আর আমার কাছে আসে না আমিও আর ওর খবর নিতে ভুলে যাই ।
মাস কয়েক পর একদিন অফিসের সামনের বটতলার কাছে ভীড় দেখে কৌতূহলী হলাম। রিক্সা থেকেই দেখা যায় ফুলির শাশুড়ির বুক চাপড়ানো ।
-' অগে মৈয়া গে। পুতোহু ডাইন বা রেএএএ।'
আবার কি হল ? পুতোহু মানে তো ফুলিয়া । সে আবার কি করে ?
-' আরে ঘোর কলযুগ আইল্ রেএএএ। পুতোহু সাস এর গায়ে হাত তোলে দেখেছো ?'
আমাকে দেখে ভীড় একটু সরে যায় । তবে ভীড়ের সহানুভূতি স্পষ্টতই বৃদ্ধার দিকে। একপাশে ফুলিয়া গনগনে চোখে দাঁড়িযে। শাড়ি কাপড় অবিন্যস্ত , আঁচল দিয়ে মাথা ঢাকা গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচালো
-' হাঁ হাঁ মেরেছি। ঠিক করেছি। হাত মুটকে দেবো। জীনগী ভর থুরতে হলই... কই তখন তো কেউ আসো নি বাঁচাতে । আজ দেখি পঞ্চায়েত বসিয়ে ফেলেছো ? '
ওর এমন রণচন্ডী মূর্তি আগে কখনো দেখি নি । মানে মানে সরে পড়লাম। যত্ত সব ছোটলোকদের কান্ড !
-' একে আর রাখা চলবে না।' পাশে হাঁটতে হাঁটতে প্রকাশজি বলেন।
পরের দিন লাঞ্চ ব্রেকে তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করছি। কাউন্টারের সামনে বেশ ভীড় । ফুলি ইতস্তত ভঙ্গিতে এসে মেঝেতে বসে পড়ল। চোখেমুখে স্পষ্ট অনুতাপ ।
-' এ দিদিইই কি যে করি বুড়িয়া আমার কথাই শোনে না। সবাইকে বলে বেড়ায় বহু একদম পতুরিয়া । হাকিমের সাথে শুচ্ছে। সেটামপ বাবুর কাছে থাকছে। রন্ডী ....। '
রুটির শেষ টুকরো মুখে দিয়ে ওর কথা মাঝপথে থামিয়ে, জানতে চাই
-' তা তোর জমিনের কি হল?'
-' জমিন তো আমার দিদিজি। সব ঠিক হয়ে গেছে। অনেক দৌড়াদৌড়ি করলাম। মজিসটিরে সাহিবা হাকিমকে ফোন করল। হাকিম বাবুজি ভলা আদমী । আউর রেজিসটরিবাবু র তো নোকরি চলে যেত । বড়ি ডাঁটলো হাকিম। তারপর কমপুটার তে ভী চড়িয়ে দিল। ' ফুলি তেল চপচপে চুলের বিনুনি ঘুরিয়ে হাসি মুখে বলে ।
-' যাক্ ! অল ওয়েল দ্যাট এন্ডস ওয়েল।'
টিফিনের আলু শেষ করে উঠে পড়লাম । ফুলি মাটিতে থেবড়ে বসেই থাকে । হাত ধুয়ে কাউন্টারের দিকে এগোতে গিয়ে মনে হল ফুলির গল্প যেন ফুরোয়নি। আমার আর শোনার সময় নেই।
বিকেলে অফিস থেকে বেরোতেই ফুলি পেছন ধরল। ও আমার ব্যাগ বয়ে দেবে।
-' সব্জি বাজার করব রে ফুলিয়া।'
-' হাঁ দিদি। করিইই না।'
বাজারের থলিটা বারান্দায় নামিয়ে ফুলি মাটিতে বসে পড়ে।
ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনটা ভিজে যায় ।
-' আরো কিছু বলবি ফুলি?'
আঁচলে মুখ মুছতে মুছতে ফুলি শান্ত গলায় বলল
-' দিদি কি করতাম বলো না? বাড়ির মরদ, দুন্নো মৌগা। অমরওয়া কে বাপু দিনভর ইধরউধর করে সময় বিতাচ্ছে। আর সসুর হুক্কা টানছে আর পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে । কি করব? আমার ছেলেদের এক টুকরা জমিন তোমরা লুটে নেবে আর আমি চুপচাপ দেখতেই থাকব?'
এক মূহুর্তের জন্য ওর চোখ জ্বলে ওঠে, এক স্কেল উঁচু গলায় বলে
-' হাঁ করেছি । পাপ পুন বুঝি না দিদি। হাঁ করেছি করম। '
হাতের চাবি হাতেই থেকে যায়। অনপড় মেয়েটি এক অন্য রূপ দেখি। বিকেলের লালচে আলোয় ওর শান্ত স্মিত হাসিমুখে এক অদ্ভুত আভা। তবে বিস্মিত হই না । এ হল গিয়ে ' মা ' সন্তানের জন্য যতদুর সম্ভব যাবে।
দিকশূন্যপুরে এক রাত
================
প্রথম যেদিন দীপা ওর মায়ের সাথে আমাদের ক্যাম্পাসে এল সেদিন থেকেই ওর সাথে আলাপ। বেঁটে খাটো ,গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, কোঁকড়ানো চুল, চশমা চোখে দীপাকে দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে ও আই বির একজন হর্তাকর্তা। নাইকির টি-শার্ট, থ্রি কোয়ার্টার টাইট লেগিং ,শকিং পিংক স্পোর্টস শু পরে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে পাক্কা চল্লিশ মিনিট হাঁটাহাঁটি করে। ঠিক পৌনে সাতটা থেকে সাতটা বাজতে দশ মিনিট বটগাছের তলায় ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ করে। আমার সাথে ওর শনি বা রবিবার কথা হয়। এক্সারসাইজ করার সময় আমি ওকে বিরক্ত করি না। তবে ঐ সময় একাউন্টসের দীর্ঘকায় কুমারজী আর ডিফেন্সের মাঝবয়সী দরিয়াপুরকরের দৃষ্টি কোন দিকে থাকে তা আমি বেশ ভালো বুঝতে পারি। দীপাও হয়ত বোঝে কিন্তু ও পাত্তা দেয় না।
দোলের আগে এক শনিবার দীপা আমাকে দেখে এগিয়ে এল।
দেশ, কাল, রাজনীতির গল্প করতে করতেই আচমকা দীপার চোখে জল। আন্টি এক সপ্তাহ আগে মারা গেছেন। সামান্য জ্বর, শ্বাসকষ্ট দেখে ওর ভাই হাসপাতালে নিয়ে যায় তারপর বিকেলে হার্ট এটাক , দীপার সাথে নাকি শেষ দেখাটুকু হয় নি। আমি সত্যিই কিছুই জানতে পারি নি। বিব্রত বোধ করলাম। বিকেলে ওর বাড়ি যাব এই আশ্বাস দিয়ে বাড়ি ফিরে এসেও মনটা খারাপ হয়ে থাকল। অবিবাহিতা দীপার কাছে ওর মা যে ঠিক কতটা ছিলেন আমরা সবাই জানি।
আন্টি চমৎকার ফুলকারির নক্শা তুলতে পারতেন। কুরুশের কাজ করে টেবিল ক্লথ তৈরি করতেন। মোট কথা কখনো খালি হাতে দেখিনি। এছাড়া কাজের লোকদের পরিচালনা করা। দীপাটা সত্যিই একা হয়ে গেল।
বিকেলে ওর সাথে অনেকটা সময় কাটালাম। সুপ্রতিষ্ঠিত মানুষের মনেও কত ক্ষোভ থাকে। আশা-নিরাশা, চাওয়া-পাওয়ার বুনুনে বোনা জীবনের বিচিত্র ইতিহাস।
এরপর তো লকডাউনে আমাদের জীবন থেকে দুটো মাস কেমন মুছে গেল। কোনো স্মৃতি নাই, কোনো কথা নাই কিছু না। হঠাৎ গত সপ্তাহে পার্কিং লটে দীপাকে দেখতে পেলাম। সরকারি বাবুদের ছুটি নেই।
- হ্যালো ! কি বোরিং লাইফ ! মানুষের মুখ দেখা নেই। কিতনা কাম ! কুকিং, ক্লিনিং! লাইফ ইজ হেল দিজ ডেজ।
- ইয়া সুচিরিতা ( অবাঙালিরা আমাকে চিরকাল অমনিই ডাকে)! এন্ড আই মিস মা সো মাচ।
- আই নো। আই ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড ।
- সব বোরিং। নিউজ বোরিং। প্রোগাম বোরিং। ইয়ার সব বোরিং। খাবার খাওয়া যাচ্ছে না। কতদিন গ্রীন খাই না। করেলা ! ইয়ার করেলা মিলতা হৈ কেয়া? আই লাভ করেলা।
ওমা করলা তো ঝুড়ি ঝুড়ি মেলে। এত কিছুর অভাবে কেবল করলা না খেতে পেয়েও লোকে কাঁদে? মনে মনে ভিরমি খাই।
-চিন্তা মত করো দীপা, আমি দেবো করলা।
প্যাকেটে করে দুটো করলা আমার ফ্রিজের গর্ত থেকে দুর করলাম।
- একদিন মার্কেট চলোগী মেরে সাথ সুচিরিতা ?
-যাবো বৈকি। আহা রে দুটো কথা বলার জন্য হাকুপাকু করে ওর মন।
এর মাঝে আমাদের বাংলা আম্ফানে ক্ষতবিক্ষত। খবর দেখি , নেটে পড়ি আর মনটা হুহু করে।
ইচ্ছে করছে না বাজারে যেতে। কিন্তু ঐ যে কথা দিয়েছি। গাড়িতে উঠতেই মাস্কের আড়াল থেকে দীপার গলা ভেসে এল
- চলো না সুচিরিতা দিকশূন্যপুরের দিকে।
- একি কবে সেদিন কি হাবিজাবি গল্প করেছি তা মনেও রেখেছো দীপা? অব কি হল? বড্ড মন খারাপ ?
ছলছল চোখে, সুরসুর করে নাক টেনে বলে - চলো না প্লিজ। তিন দিনের ছুটি। মঙ্গলবার ম্যানেজ করব। আচ্ছা লাগলে ওখানেই থেকে যাবো।
এ বাবা বলে কি? ভাগ্যিস মুখ মাস্ক ঢাকা আর ও আমার মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পায় না।
এই তো কদিন আগেই নীললোহিত সমগ্রের পাঁচটা খণ্ড পড়ার পর এত যেতে ইচ্ছে করছিল। কাকতালীয় ভাবে আবার আজকেই দিকশূন্যপুরের নাম উঠে এল।
- দীপা মুশকিল আছে। ওখানে পিছুটান থাকলে যাওয়া যায় না।
- নাই নাই পিছুটান। মা নেই ঔর কি আছে আমার এখানে ? নৌকরি ? ঘর? রূপয়া পৈসা? কিছুই ভালো লাগে না সুচিরিতা।
বিড় বিড় করতে করতে দোকানের সামনে এসে দেখি সব বন্ধ। খাঁ খাঁ চারিদিক। বন্ধ দোকানের সাটারের সামনে দাঁড়িয়ে করলা আর সবুজ ভিন্ডির বিহনে দীপা আরো মুহ্যমান হয়ে পড়ল। অনেক ঘুরে অল্প স্বল্প যা পেলাম তাই ভাগ করে কিনলাম। ও একা ,আমি দোকা । দুজনেরই চাহিদা অল্প। মেথিশাক,ধনেপাতা, পুদিনাপাতা , লঙ্কা সব ভাগাভাগি করে নিজ নিজ বাসায়।
কদিন পরপর দুবার দিকশূন্যপুরের কথা উঠল বলে মনটা যেন টানছে। বন্ধুরা দলবেঁধে কত জায়গায় যায় । কত হইচই ,কত না আনন্দ ! আর আমি ঘর গোছানো নেই, রান্না করা নেই এই সব অজুহাত দেখিয়ে কোনোদিন গেলাম না। এই করেই জীবনটা গেল।
রান্না বাড়া সেরে, ধুয়ে মুছে, খেতে বসতে অনেক বেলা। আনমনে পাতে গরম ভাত নেবার আগেই তিনি বিরক্তির সাথে গমগমালেন
- ধনেপাতা ! মাছের ঝোলে ধনেপাতা দিয়েছো , আবার লাউ ছেঁচকিতেও ধনেপাতা?
নিজের খাবারে দাও না যত রকমের পাতা।
গরম ভাতের গন্ধে খিদে বেড়ে যায়। তবে কষ্ট করে রান্না করা খাবার দেখে গজগজ করলে মনে বড্ড ঘা লাগে। চোখে জল ভুরু দিয়ে চেপে ভিতরে ঠেলে পাঠাই আর হাতা দিয়ে সবুজ পাতাগুলো সরাতে থাকি। যত্ন করে করা লাউ ছেঁচকি, মুগের ডাল সব বিস্বাদ। সিঙ্কের সামনে বাসন ধুতে ধুতেই মনস্থির করে ফেললাম। চলেই যাই তবে । এত করে দীপা বলছে। এইবারে সত্যিই আমার ডাক এসেছে। দীপাকে ঝটপট করে মেসেজ করলাম। ও রেডি। আমিও তো রেডি।
জানো তো দিকশূন্যপুরের ঠিকানা? যে কোনো জায়গা দিয়ে যাওয়া যায়। কখনো কখনো আবার কাছেও টেনে আনা যায় দিকশূন্যপুর কে। দুপুর তিনটে নাগাদ আমাদের লাল গাড়ি শাঁ শাঁ করে নিঝুম পথ ধরে এগিয়ে চলল।
- আচ্ছা লাগছে জানো? তুমি রাজি হলে খুব বঢ়িয়া হল।
- মুঝে ভী অচ্ছা নহী লগ রহা থা দীপা, মন বহুত উদাস।
- মাকে দেখতে পেলে আর আসব না।
- কি বলছ ? দীপা ! তুমি কি সাকসেসফুল!
- তুমি জানো দরিয়াপুরকর আমাকে বলছে -সোশাল বনো। ভার্মা আমার দিকে কি বিশ্রী ভাবে তাকায়। মা চলে গেল বলে এরা সাহায্যের নাম করে সুযোগ নিতে চায়।
- আরে তুমি তো স্বাধীন। স্বাবলম্বী। তুমি ওদের পাত্তা দিও না।
- আই অ্যাম টায়ারড ইয়ার। সো টায়ারড। টায়ারড অফ ক্যারিং দ্য শিল্ড এরাওন্ড মি।
- আমিও টায়ারড দীপা। আমিও ক্লান্ত। ঘরবাড়ি গুছোতে গুছোতে ক্লান্ত। লোককে খুশি করতে করতে ক্লান্ত। সংসারের খেলা খেলতে খেলতে ক্লান্ত।
গাড়িটা আপনা আপনি শিবডী কোলি কলোনি হয়ে সমুদ্রের ধারে এসে দাঁড়ালো। পরপর কয়েকটা জেলেদের নৌকা দাঁড় করানো। অনেকদুরে এক আধটা লোক দেখা যায়।
- আমি যে নৌকো চালাতে জানিনা। উত্তেজনায় দীপার গলা থরথর করে কাঁপছে।
স্থির বিশ্বাস আমার , আমি জানি কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই।
কাঠ কুটো, প্লাস্টিকের নোংরা মাড়িয়ে নৌকাগুলোর দিকে এগোলাম। এক বৃদ্ধ একমনে নৌকার পাশে পা ছড়িয়ে বসে কুকুরের গায়ের পোকা বাছে।
- বাবা আপকা নাও ?
বৃদ্ধের মুখ জুড়ে সরল হাসি।
চারিদিক ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আসে। নির্ভীক চিত্তে দুজনেই নৌকায় উঠে পড়ি। বৃদ্ধ দড়ি খুলে দেয়। নৌকা টলমল করতে করতে গভীর জলের দিকে এগোতে থাকে। দীপার মুখে তৃপ্তির হাসি। বাচ্চার মতন সমুদ্রের জলে হাত দিয়ে খেলছে। আমার মনটা যে কেমন তা কি লিখে বোঝানোর ক্ষমতা আছে? কত বছরের ইচ্ছে আজ পূর্ণ হতে চলেছে। এই গরমেও যেন কুয়াশার চাদরে চারিদিক ঢেকে গেল। তরতরিয়ে নৌকা চলেছে। প্রবল হাওয়ার বেগে আমাদের চুল উড়ে উড়ে যায়, ওড়না বেসামাল । আমাদের মনে একফোঁটা ভয় নাই।
মুখে না বললেও ভাল লাগলে থেকেই যাবো এটা মনে মনে ঠিক করে রেখেছি।
হঠাৎ নাও এক জায়গায় থামল। মনে হল নামতে হবে। এসে গেছি নাকি? এ নীলুর বলে দেওয়া পথটা না। অনেকটা বালিয়াড়ির পর দেখা যায় ঝাউগাছের সারি। দুজনে টালমাটাল পায়ে জলে নামব। হুই দুরে দেখা যায় তিনজন মানুষ । দীপাই প্রথমে ওদের দেখতে পেল।
মা, মম্মাআআ বলে তড়বড় করে জলে ঝাঁপ দিয়ে ছুটতে লাগল। ওর জিন্সের প্যান্ট, গোলাপি স্নিকার ভিজে গেছে। নৌকা লগবগ করে দুলতে থাকল। আমি কোনোমতে নেমে ওর পিছনে ছুটছি। আমার বুড়ো হাঁটু কি ওর চল্লিশ মিনিট জগিংএর দমের সাথে পাল্লা দিতে পারে।
-মেরি মা কো দেখা ! কোথাও দেখেছো নাকি? রজ্জো আমার মায়ের নাম। ফর্সা লাঠি নিয়ে হাঁটে ।
এক বৃদ্ধ , এক যুবতী আর এক প্রৌড়ার সামনে দাঁড়িয়ে দীপা হাত নেড়ে নেড়ে কত কি বলে যায়। তারা তিনজনই মাথা নেড়ে এগোতে উদ্যত হয় দেখে আমি বললাম
- আপনি কি বন্দনাদি?
মাথায় লালচে ফেট্টি বাঁধা ,ঘাঘরা পরা রমণীটি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললেন
- বসন্ত রাও এর এক বন্ধু আসার কথা পুণে থেকে। তাই দেখতে এসেছিলাম। দীপার মা তো আসেন নি এখানে।ওকে বুঝিয়ে বলে দাও।
দীপা আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে দেখে এক ধাক্কায় আমাকে মাটিতে ফেলে ছুটতে ছুটতে জঙ্গলে উধাও হয়ে গেল। অল্পবয়সী মেয়েটির হাত ধরে উঠলাম।
- লাগে নি লাগে নি গো।
নৃত্যশিল্পীদের হাঁটাচলা, তাকানোর মধ্যেই একটা ব্যাপার থাকে। বন্দনাদির কত বয়স কিন্তু বোঝাই যায় না। বরং বসন্ত রাও কে একদম থুত্থুড়ে লাগছিল। মেয়েটির নাম টিনা বছর পাঁচেক আগে এসেছে।
- তুমি সেদিন তোমার স্কুলের বন্ধুদের সাথে এলে না কেন? ওরা কেমন গান,গল্প আড্ডায় মাতিয়ে রেখেছিল। পুষ্পা তোমার কথা বারবার বলছিলেন।
মাথা নীচু করে হাঁটতে থাকলাম। এ প্রশ্নের কি উত্তর দেব ?
জঙ্গলের দিক দিয়ে দিকশূন্যপুরে ঢুকলাম।
- নীলু কখনো এদিক দিয়ে আসত না ।
- আপনি হাঁপাচ্ছেন রাও। একটু বসি। আমার কথা শুনে রাও বাঁ হাত নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলেন উনি ঠিক আছেন।
একদল পাখি দেখে অবাক হলাম। টিনা আঙুল তুলে দেখিয়ে চেনালো হুইসলিং ডাক, গ্রে হেরন। কি সুন্দর !
- তোমরা পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছ তাই ওদের দেখা পাও না। সকালের দিকে এলে দেখবে কত শত পাখির মেলা। টিনার গলার স্বর কেমন পুরূষালি।
- হ্যাঁ মুম্বাই তে এখন প্রচুর ফ্লেমিঙ্গো দেখা যাচ্ছে। টিভিতে দেখেছি নভী মুম্বইয়ের ক্রিকের জলের রঙ গোলাপি হয়ে গেছে। এ সব লকডাউনের সুফল।
-আবার তোমরা একই কাজ করবে। একই ভাবে পরিবেশের সাথে ছেলে খেলা করবে।
বসন্ত রাও এর এই কথারও আমার কাছে কোনো উত্তর নেই।
সন্ধ্যা নামার আগে গাছের ছায়া ঘন হতে লাগল। কুলকুল করে বয়ে যায় নালা। তার পাশে এক উশকো খুশকো চুলো মলিন জামা পরা ছেলেকে দেখে অবাক হলাম।
-ও বন্দনাদি, এখানে শিশু কেন? বাচ্চাদের এখানে আসতে দিচ্ছ তোমরা! এমন তো কথা ছিল না।
- ওর বাড়ির লোক ট্রাক এক্সিডেন্টে মরে গেছে। ওর আর কেউ নেই। যেদিন থেকে এসেছে ওখানেই চুপটি করে বসে আছে। ইচ্ছে হলে পেয়ারাটা, কলাটা খায়।
- আহারে টিনা, ও কি পরিযায়ী শ্রমিকের সন্তান ?
ওরা নিরুত্তর। ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখে। ওর চোখের জলে গালের ভেজা দাগ , মর্মভেদী দৃষ্টি আমার হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়।
মাথা নীচু করে বিড়বিড় জানতে চাই
- আর কতদূর?
- এই তো পৌঁছে গেছি। বন্দনাদি পিঠে হাত দিয়ে বলে।
-দীপা? দীপার কি হবে?
-এখানে কেউ হারায় না সুচরিতা ।
পরপর অনেকগুলো কটেজ দেখতে পেয়ে মনটা খুব ভালো হয়ে গেল। সত্যিই এ জায়গাটা যেন স্বর্গ।অন্ধকার নেমে এসেছে। আমি বাপু বাইরে ঘুমোতে পারব না। খোলা আকাশের তলায় আমার খুব ভয় করে। মাঝরাত্তিরে টিমটিমে তারাদের দেখলে কোনো কবিতা মনে আসে না। যদি থাকে মেঘলা আকাশ তখন সেই উড়ে যাওয়া থোকা থোকা মেঘ দেখলে আমার বুক শুকিয়ে যায় । আমার জন্য বাপু মাথার উপর ছাদ চাই।
ইসমাইল ভাই আর রোহিলা সবার জন্য চমৎকার পেঁয়াজ দিয়ে মুসুর ডালের খিচুড়ি রান্না করে রেখেছে। সুঘ্রানে পাড়া ম ম। তবে অল্প খেতেই আমার ভীষণ হেঁচকি উঠতে লাগল। আমি যে একদম ঝাল খেতে পারি না।
পাখির সম্মিলিত কলতানে ঘুম ভেঙ্গে যেতেই ছুটে বাইরে এলাম। ভোরের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে। দিকশূন্যপুরের গন্ধটা আরো মাদক , আরো তীব্র। কে কোথায় জানিনা, পায়ে চটি নাই, কাল হাতে পায়ে ক্রীম লাগাই নি, কালকের বাসী পোষাক তবু কোনো অসোয়াস্তি নেই।
হরিণেরা আমাকে দেখেই ছুট্টে পালায়। শহুরে গন্ধ পেয়ে মাথার উপর দিয়ে লাফিয়ে পালায় হনুমানের দল।
কাল অতটা খেয়াল করি নি। বিধ্বংসী ঝড়বৃষ্টিতে হাত থেকে দিকশূন্যপুর রেহাই পায় নি। কয়েকটা মহীরূহ বাঁশ আর মোটা মোটা দড়ির ঠেকনো দিয়ে খাড়া করা। মনে হচ্ছে উপড়ে পরা গাছগুলোতে কে যেন সযত্নে আবার মাঁটিতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে। তার গা বেয়ে উঠে নামে কাঠবেড়ালি।
মনটা আনন্দে ভরে গেল। এই নাহলে দিকশূন্যপুর ! আমাদের চেনা জগতে উপড়ে পড়া গাছেদের করাত দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে বেচে দিচ্ছে ওরা। একটু বাঁচানোর চেষ্টা অব্দি করল না।
গাছেদের আড়ালে কার যেন গলা শোনা যায় । কৌতূহলী হয়ে এগোতে দেখি ওমা এরা তো সবাই চেনামুখ! মোটা একটা দড়ি অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় জড়াচ্ছে চাটুজ্জে । ঠেলে ধরেছে রাণা, চয়ন আরো কজন। সুজয় ওদের কিছু একটা বলছে।
আমাকে দেখেই সুজয় এক গাল হাসি দিল
- দিদি এই গাছটা সোজা করতে পারলেই আমাদের কাজ শেষ। তারপর বিরিয়ানি খাওয়া কেমন? ঠিক মনে হল যেন আমার আসার কথা ও আগে থেকেই জানত।
বাকিরা পরিশ্রমে গলদঘর্ম। হেঁইয়ো হেঁইযো করে টানাটানি। আমি হাত লাগাতে অরিন্দম বেশ বিরক্ত হল।
আমার হাসি পেল। চিনি তো ওকে। খুব পরিশ্রমী। যেটি ভাববে সেটি করেই ছাড়বে। যতক্ষণ কাজটি সারা না হবে কোনো কথাই বলবে না।
আধ ঘন্টার পরিশ্রমে খানিকটা সোজা হল । ততক্ষণে রোহিলা আর জয়দীপ তুলসীপাতা, আদা, লেমন গ্রাস ফুটিয়ে একটা চায়ের মতন উষ্ণ পানীয় তৈরি করে আনল।
- দিদি তুমি কখন যাবে?
- রাণা , আমি যে এখানেই থাকব ঠিক করেছি।
- মোটেই না। চয়নের মাস্টারসুলভ দরাজ গলা।
- কেন মাঝে মাঝে তোমরা দেখা করে যেও। আমার সব কাজ শেষ। কোনো পিছুটান নেই। এই দিকশূন্যপুরই আমার জন্য বেশ।
- দিদি বিশ্বাস করো এটা খুব এডিক্টিভ জায়গা। মানুষ ঘোরে পড়ে যায়।
- জানি তো তুমি কদিন আগে ঘুরে গেছো। তাই তো ইদানিং তোমায় কোথাও দেখা যাচ্ছিল না।
অরিন্দম এক চুমুকে চা শেষ করে বলল
- ধুসস্ যত্ত সব এসকেপিস্ট মানসিকতা। কর্ম করো । কর্মই জীবন। কাজ বাদ দিয়ে দিকশূন্যপুরে বসে বসে হাওয়া খাওয়া। চরম রোমান্টিক ব্যাপার ! কেন পৃথিবীতে কাজের অভাব আছে নাকি?
চয়ন আড়মোড়া ভেঙ্গে চশমা ঠিক করতে করতে হা হা হেসে গড়গড়িয়ে বলতে লাগল
- বুঝলেন দিদি এই জার্মান ছোকরা নিজেও পাগলা , আমাদেরকেও পেগলে দেবে। সেদিন সবাই পিকনিক করে ফিরছি। দুদিন পুরুলিয়া কাছে একটু রেস্ট নিচ্ছি। ঝড় উঠলো। ভাঙা , শিকড় ওপড়ানো গাছের ছবি দেখেই অরিন্দম উত্তেজিত হয়ে উঠল। কি না দিকশূন্যপুরের গাছপালার কি হল দেখতে যাবে। কি করা চার মক্কেল দুটো বাইকে ফেরত এলাম। আর দেখুন এখন এই বনবাদাড়ের গাছ সোজা করছি। একি সহজ কাজ নাকি?
আহা সুজয়টার চেহারাটাই বড় , একেবারেই ভালোমানুষ দেখছি। হাত দুটো মেলে করুণ গলায় বলে
- দেখেছেন দিদি কেমন চামড়া ছড়ে গেছে।
- কাজ সারা হলে আপনি আমাদের সঙ্গে ফিরবেন। রাণার স্পষ্ট আদেশ।
বন্দনাদি কোথা থেকে মিহি মাটির লেপ এনে লাগালেন ওদের হাতের চেটোয় ।
- এ মক্কেল দুটো আজকাল ভালোই আছে দেখি। দিব্বি চা ফা খাওয়াচ্ছে। চয়নের অমায়িক গলা জয়দীপ ,রোহিলা সমেত সবার কানে পৌঁছায়।
- ও মা , তোমাদের এক চেনা সাইকিয়াট্রিস্ট ওদের খুব ভালো কাউন্সিলিং করে গেছে ! দুদিন ধরে কত রকম ভাবে বুঝিয়েছে। এছাড়া আমরা ওদের সাথে কিভাবে কথা বলব সে বিষয়ে অনেক পরামর্শ দিয়েছে। কদিন তো বেশ উন্নতি দেখছি।
বন্দনাদি সযত্নে জয়দীপের কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে জানালেন।
দুপুর হতে হতে আরো অনেকে গাছেদের পরিচর্যায় যোগ দিল। অরিন্দমের কাজ শেষ। ওরা হাত মুখ ধুয়ে দুধ-চিঁড়ে খেয়ে ফেরত যাবার জন্য তৈরি হল।
আমি ওদের সাথে যাব না বলে দিলাম। দিকশূন্যপুরে জোর খাটানোর নিয়ম নাই। সুজয়ের মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেছে বুঝতে পারছি। চয়ন বারে বারে পেছন ফিরে তাকায়।
অরিন্দম হেঁকে বলে - চলি গো সুচরিতাদি। পারলে ফিরে এস। অপেক্ষায় থাকব। বিদায় দিকশূন্যপুরবাসীরা।
হাত নেড়ে বিদায় জানাই ওদের।
চোখে পড়ে সেই বিখ্যাত ব্ল্যাক বোর্ড। কদিন কিছু লেখা হয় নি মনে হল। ওড়না দিয়ে যত্ন করে মুছে লিখতে গিয়ে কিছুই মনঃপূত হয় না। শেষে 'সপ্তপর্ণী' আর গাছপালা দিয়ে একটা ডুডল এঁকে দেখলাম নাহ্ বেশ ভালোই দেখাচ্ছে।
ধীরে ধীরে চারিদিক আবার নিস্তব্ধ হয়ে আসে। এমন সবুজ রং আগে দেখি নি। টিই টিই করে পাখির ডাক শোনা যায়। রঙিন প্রজাপতি, ফড়িংদের মেলা বসেছে। হঠাৎ ঐ বাচ্চাটার কথা মনে হল। দেখে আসি তো ও কি করছে? জলের ঝোরার পাশ ধরে আন্দাজে এগোতে থাকি।
একটা বাঁক ঘুরতেই অবাক হয়ে দেখি দীপা ছেলেটিকে খাইয়ে দিচ্ছে। আমাকে দেখেই দীপা ভীষণ রেগে চেঁচাতে লাগল
-' ওয়াটস দিস সুচিরিতা? ওয়াই ডিড ইউ লিভ মি এলোন?
নাও ঠ্যালা আমি ওকে ছাড়লাম না ও আমায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে পালালো ?
আমার উত্তর না পেয়ে ও আরো জোরে চিৎকার করে উঠল
- ওয়াটস দিস ? বাচ্চা অনাথ হৈ তো খানা নহী দোগে? খেতে দেবে না? ওর খিদে পায় না? ঠান্ডা লাগেনা ? চলো চলো একে আমি বাড়ি নিয়ে যাবো। আমার সাথে থাকবে। ও মম্মীর বেডে ঘুমোবে। পাড়ার কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে পড়বে । এক হ্যাঁচকা টানে বাচ্চাটা উঠে পড়ল।
জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে সবাইকে ভস্ম করে দিতে দিতে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল
-মোস্ট ইরেসপনসিবল পিপল।
কি আর করব ? অগত্যা আমিও চললাম ওর পিছু পিছু ।
*****
পুনশ্চ: ১-গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো । এক শহরে থেকেও দেখা হয় নি এ দুঃখ জীবনেও যাবে না।
২- আম্ফানে উপড়ানো গাছগুলো টিভিতে দেখে খুব মন খারাপ হয়েছিল, তখনই লিখেছিলাম। সপ্তপর্ণীতে দিলাম বলে কিছুটা বদলে দিয়েছি।
দাদা-ভাই
-------
বছর দুয়েক হল আমাদের বাড়ির উত্তর পূর্ব কোণে বাড়ছে একটা বড় নিম গাছ। গাছটা বাউন্ডারি ঘেঁষে লকলক করে বেড়ে উঠছে। বাউন্ডারির বাইরে একটু সবুজ পট্টির মত জায়গা ছেড়ে লাল মোরাম বিছানো রাস্তা। পাগলা কুলি বুধন একদিন সেই ফালিতে নিমের গাছ বরাবর দেওয়ালের ওপাশে একটা করৌঞ্জ গাছ পুঁতল।
বুধনের গাছ পোঁতা যেন এক উৎসব। কালো খড়ি ওঠা গা, কাঁচাপাকা চুল-দাড়ি , নোংরা পায়ের দিকে ছেঁড়া ফুলপ্যান্ট, কাঁধে কোদাল, হাতে বনবিভাগ থেকে পাওয়া কটা চারা নিয়ে পাগলা হাসি হাসি মুখে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। সেদিন আকাশ গমগমে মেঘে ঠাসা। হাওয়া বন্ধ। গুমোট। কালো, কালো ডেঁয়ো পিঁপড়ের দল লাইন করে চলেছে। বোঝা যায় জোর বৃষ্টি নামবে। ঠাম্মা কুয়োর পারে দাঁড়িযে ছাড়া কাপড়চোপড় জলকাচা করছে। এমনসময় বুধনা গাছ সমেত ডান হাতটা এগিয়ে হাসিমুখে বলল
- মাঈজি!
পিপি রান্নাঘর থেকেই ঠিক টের পেয়েছে।
- এএএ বুধন তুম সচ মে পগলা হৈ। তুমি সত্যিকারের পাগল। শখ করে গোলাপের কলম করা শিখছিলাম। তুমি সেদিন এসে সব ছেঁটে ফেললে?
এখন পিপি নিজেরই একটু মাথা খারাপ। গত সপ্তাহে গোলাপ গাছ ছাঁটার সময় বুধনা নির্মম ভাবে মুড়িয়ে কেটেছে, তাই ও আজ ভয়ানক খেপে আছে । আহা বুধনা বেচারি জানতে না। নাহলে ও ওর বেবিদিদির এক্সপেরিমেন্ট ভন্ডুল করার হিম্মত করত না। তবে পিপিকে এখন কে বোঝায়? খানিক চেঁচামেচির পর বুধনা ঠাম্মার পারমিশন নিয়ে জায়গা বেছে ঠাং ঠুং করে গর্ত খুঁড়তে লাগল। আধ হাত গর্ত খুঁড়েই বুধনার নাচ পায়। দু হাত আকাশের দিকে তুলে ও টেনে টেনে গান গায়। আমি ওর একটা কথাও বুঝি না। কেবল সুরটা আজো তক কানে লেগে আছে।
হেএএএ টিটিং টিটিং টিলা ... টিলা টিলা হেইইইই হেই রেএএ...
একটু পরে কোদাল চালানো শব্দটা গম্ভীর হয়ে যায় ধুপ-ধুপ , ধুপ-ধাপ । মাটি খোঁড়ার ডিপ ব্যারিটোন আওয়াজ হতেই আমরা জানি এবার যথেষ্ট গর্ত হল। পাড়ার যত কুচিকাচাদের দল বেরিয়ে বুধনার পাশে ভীড় জমাই। পাগলা বুধন ঠাম্মার কাছ থেকে আনা সিন্দুর দিয়ে মাটির গর্তে মারাংবুরু না কে জানে কার পুজো করে। গর্তের চারিদিক ঘিরে লাফিয়ে লাফিয়ে নাচতে থাকে। মাদল ঢোলের পরিবর্তে আমরা বেতালাদের দল তাল দিই।
-' হঁ রে বুধনা জল্দী কর। জোর সে নামবে। ঠাম্মার গলার আওয়াজের সাথেই টিপ টিপ বৃষ্টি আরম্ভ হয়ে যায় ।
কালো প্লাস্টিকের খোলস থেকে বের করতেই বুধনার নাচের সাথে কচি পাতাগুলো তির তির করে নেচে উঠল। বুধনের গানের সুর জোরে আরো জোরে ।
টিলা টিলা লালা লালা রেএএএ....
গর্তে গাছটা দাঁড় করিয়ে মাটি ফেলতেই আমাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সবাই একেক মুঠো মাটি দেব। আমাদের বাড়ির সামনে তাই আমার আর নীলির অধিকার সবচাইতে বেশি। আনন্দের সিংহভাগই আমাদের দুজনের। আকাশ থেকে নামছে বরফের মত ঠান্ডা জল। হু হু করে হাওয়া দিতে থাকে ।
-' ওরে ভিজিস নাই রে । জর হবেক।'
আমরাও শীতে কাঁপতে কাঁপতে আপনার ঘরকে ঢুকে যাই। টিনের চালের জলের আওয়াজে বুধনার উল্লাস চাপা পড়ে যায়।
এঁটেল লাল মাটি নখের কোনায় কোনায় ঢুকে গেছে। একটা পচলা পারা গন্ধ। কচলে কচলে হাত পা ধুই। জামাপ্যান্ট ছাড়ি।
-যা বৃষ্টি আরম্ভ হল । বুধনাটোকে ঘ্যরে ড্যেকে আন।
আমার দুজন প্রানপণে চেঁচাতে থাকি - বুধনাআ এ বুধঅঅঅন....
বুধন তিনটে ইঁটের ত্রিভুজ করে তার ওপরে ভাঙ্গা টুকরি সেট করে রেখেছিল। ঠিক সাতদিন পরে সেই বেতের ঝুড়ি তুলে দেখা গেল গাছটা দিব্যি বেঁচে গেছে।
আমরা ওর নাম দিলাম ভাই। রোগা টিঙটিঙে নিম গাছটা হল গিয়ে দাদা । সে ততদিনে বাড়ির একতলা ছুঁয়েছে।
বাবা একদিন অফিস থেকে ফিরে খুব রাগারাগি করলেন। নিম, করৌঞ্জ মিলে বাউন্ডারিটাকে দেবে ফাটিয়ে। কমন দেওয়ালের পাশে হলে সারানোর পয়সা ভাগ হত। সামনের দিকের বাউন্ডারি ফেটে গেলে আমাদেরকেই খরচ করতে হবে।
-বলি গাছটা পুঁতল কে?
সবাই চুপ। কেবল পিপি গজগজ করতে করতে শুনিয়ে দিতে ছাড়ে না- হুঁ , কদিন ধরেই ইঁটের ওপর ঝুড়ি চাপা দেওয়া তখন দেখতে পারিস নাই ?
পিপি সেদিন বুধনাকে গাল দিলে কি হবে, এখন ঐ
চারাগাছ আর বুধনা জন্য জান দিয়ে দেবে। পিপির অমনিই স্বভাব। চিরকাল আন্ডারডগদের ফেভার করে। আমাদের ওপর পিপির ভয়ানক শাসন। আমাদের তো মা নেই কিনা। তবে অন্য কেউ বকে দেখুক পিপি তার চুল ছিঁড়ে নেবে।
সেদিনের ঝগড়াঝাঁটি আর চেঁচামেচির রেজাল্ট 1-0 । মানে গাছটা টিকে গেল। পিপি যখন বাবাকে দাবড়ে দেয় তখন আমরা খুব খুশি হই। পিপিই জিতেছে তাই ঝগড়াটা বেশিক্ষন টিকল না।
দাদা আর ভাই হাত ধরাধরি করে বাড়ে। নিমের তলায় একটা সিরসিরে হাওয়া পাই। গোড়াটাও কেমন মজবুত হয়ে উঠেছে । আমি আর নীলি ভাগ করে নিয়েছি আমাদের গাছ। নীলি বাবাকে বলে ওর নিমগাছের ডালে একটা দড়ির দোলনা ঝুলিয়েছে। করৌঞ্জটা যে সত্যি আমার ভাই এতে কোনো সন্দেহ নাই। মন খারাপ হলে ডালপালা দুলিয়ে দুলিয়ে আমার কথা শোনে। ঝিরঝিরে হাওয়া বুলিয়ে দেয় গায়ে। মুল বাড়ির বাইরে হলেও আমরা সবাই ওকে নিজেদের মত ভালবাসি। বর্ষার আগে রাস্তার দুধারের গাছ ছাঁটার সময় আমি কড়া পাহারায় থাকি। এদিকে নীলির সমস্যা ব্যাপক, বছরভর লেগেই থাকে । পাড়ায় কার নাক কান ফুটো হল চলল আমাদের গাছ থেকে ডাল পাতা পাড়তে। পাড়ায় রাসমনি দিদার নিম বেগুন খাবার ইচ্ছে হল ব্যাস কচি পাতা মুড়িয়ে তুলে নে গেলো । চিকেন পক্স হলে তো কথাই নেই। ঠাম্মা বলে নিমপাতা চাইলে না করতে নেই।
বুধনা এখন আরো বুড়ো হয়ে গেছে আর আরো পাগলা। মাঝে মাঝে এসে চা রুটি খেয়ে যায় আর চোখ ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে। মাঝে মাঝে হাঁড়িয়া খেয়ে নেশা করে ঝগড়া করে আর বাড়ি ছেড়ে আমাদের করৌঞ্জ গাছের তলায় গামছা পেতে শুয়ে পড়ে।
দোলনার দড়ি ঠিক করতে গিয়ে নিমগাছের ডালে সেদিন একটা কাকের বাসা দেখতে পেলাম। ধাড়ি কাগটা একটু হলেই চোখের কাছে ঠুকরে দিত
- আররে দ্যাখ দ্যাখ, আমি কি জানি যে এখানে তোদের বাসা আছে?
মাটিতে পড়ে যাওয়া চশমাটা তুলে জোরে জোরে বলি।
শীতের বেলা ঝট করে ফুরিয়ে যায়। তিনটের সময় কাজ সেরে ঠাম্মা কুয়োর পাশে খাটিয়ার ওপর রোদে দেওয়া লেপ উল্টাতে গিয়ে দেখে নীলিটা লেপের তলায় ঘুমিয়ে কাদা। ওর নোংরা পায়ের লাল ধুলো লেগে সাদা লেপের ওয়ার নোংরা ছোপ। ঠাম্মার চেঁচানিতে নাকি চিল উড়ে যায়। কান ধরে নীলিকে তুলে দিল।
আমি চুপচাপ ভাই গাছের ডালে উঠে লুকিয়ে পড়লাম। বিকেল হলেই খিদেতে পেট চুঁই চুঁই। আমার সবসময়ই খিদে লাগে। লাল টুকটুকে ফলগুলো দাঁতে কেটে কেটে থুথু করে ফেলে দিই। ফুলমনিয়া বলেছে করৌঞ্জ এর ফল, পাতা, ডাল সব নাকি ওষুধ। সন্ধ্যা হবার আগে দল দল পাখি অবিকল আমাদের স্কুল ছুটির সময় হৈচৈ করতে থাকা বাচ্চাদের মতন কিচিরমিচির করে । লাল আকাশ জুড়ে বাসা ফেরত যাওয়া পাখির দল। আস্তে আস্তে ডাল ধরে নামি। কি আর করব যাই গিয়ে এবার বাড়ি । ঝুপ করে লাফিয়ে মাটিতে পা দিতেই চোখাচোখি হল ফোলিও ব্যাগ হাতে বাবার সাথে।
আমাকে দেখা মাত্রই বাবার মুখটা রাগী রাগী। পিছন থেকে সরসরিয়ে বয়ে আসা হাওয়া গাল মুখ মাথা ছুঁয়ে আশ্বস্ত করে।
রাতের খাবারের সময় দেখা গেল নীলির ধুম জ্বর। রুটি আর ডুমুরের তরকারি খেতেও উঠল না। পনের দিনের জ্বরে নীলি যেদিন এক্কেবারে ঘুমিয়ে পড়ল সেদিন ওর মুখ চোখ একেবারে কালো, হাঁ মুখ থেকে ছোট ছোট দাঁত উঁকি দেয় আর একটা চোখ আধখোলা।
পিপি নীলির জন্য হা হা করে কাঁদল। ঠাম্মা বলল নীলি গেছে মায়ের কোলে। আমি কোথায় যাই? তাই গিয়ে দুলতে থাকি নীলির দোলনায়।
দোলনাটা দুলে যখন ওপরের দিকে যায় তখন চোখে পড়ে ছাতের একটা অংশ। লুকোনো সেই জায়গায় বাসা বেঁধেছে মৌমাছিরা।
নিম করৌঞ্জ এর স্বাদের মধু ঠাসা মস্ত বড় চাক।
মন খারাপ হলেই দাদা আর ভাইয়ের কোলেপিঠে চাপি। ঠাকুরদ্দার ভাঙ্গা বাক্স থেকে খুঁজে বার করা পুরোনো বাইনোকুলার দিয়ে দেখি মৌমাছিদের আনাগোনা। ওরাই আমার সবচাইতে আপন।
অদ্বিতীয়া
=======
আমি অদ্বিতীয়া। অদ্বিতীয়া রায়। ঐ যে বিছানায় উপুড় হয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে সেটা আমার মা আর ডাইনিং চেয়ারের পাশে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা আমার বাপি। আমি বাপি-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাকে ঘিরেই তাদের জীবন। সে অবশ্য বিরাট কিছু না সব বাবা মায়েদের জীবনটা তাদের সন্তানকে ঘিরে। আচ্ছা মাঝে মাঝে যে এত বাড়াবাড়ি, খাও খাও , চারটে চোখ সমানে তাকিয়ে থাকা ,হাঁসফাঁস করে না বুঝি আমাদের ? স্পেস , একটু ব্রিদিং স্পেস লাগে না?
আমার ছোট্ট বেলা
-------------------------
মনে আছে যখন থেকে আমি তখন থেকেই গান গাই। বাপি খুবই ভালো গান গায়। মা শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছে। গলায় ভোকাল নড্য়ুল আছে বলে যখন তখন গলা ভেঙ্গে যায়। তাই আর গান গায় না। তবে সব সময় গান শোনে। খুবই ভালো বাসে রবীন্দ্র সংগীত, অতুলপ্রসাদের গান।
এই জন্যই হয়ত আমি যে কোনো গান গাইতে পারি। কবিতা আবৃত্তি করতে পারি। নিজে থেকেই শুনে শুনে হারমোনিয়াম বাজাতে শিখে গেছিলাম। এমনকি কর্ড দিয়ে বাজাতে পারতাম সেই চার পাঁচ বছর থেকেই । কেউ বাড়িতে এলে এটা ওটা খানিক গল্পের পর হারমোনিয়াম বেরিয়ে যেত।
অমনি প্যাঁ-প্যাঁ করে বাজিয়ে গান শোনাতে হত। তখন আমার চাইনিজ কাট চুল। দুটো কিংবা একটা পনিটেল আর খুব কুঁচি দেওয়া গোলাপি ফ্রক। সবাই গান শেষ হলেই বলত
-ও মা! যেন পুতুল ! কি মিষ্টি, কি মিষ্টি!
বাপিই শেখাত । দুজনে মিলে গলা সাধতাম।
ছোট ক্লাসে তখন হয়ত ওয়ানে পড়ি স্কুলে ফাংশানে আমরা গাইলাম , আর আরো অনেকে নাচ করল।
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে ....
আমার খুব ভাল লাগল। দেখে দেখেই শিখে নিয়েছি। বাড়িতে বাপি মাকে নেচে গেয়ে দেখালাম। ওরা কি খুশি ! চুমু খেয়ে আদর করে আমাকে ভরিয়ে দিল। এর পর নতুন খেলা বাড়িতে অতিথি এলেই আমি তৈরি কখন ডাকবে। এবার বাপি গাইবে আর আমি মন দিয়ে... এ জীবন পূর্ণ করো নেচে নেচে দেখাব। নিখুঁত ভাবে তোলা। সেবারই পুজোতে পাড়ায় নামী শিল্পীরা আসার আগে বড় বড় দিদিদের সাথে গান গাইলাম। স্টেজে ওঠা, আলো, সারি সারি উৎসুক মুখ, হাততালি খুব ভালো লাগল। বিজয়া সম্মিলনী তে কচি-কচি গলায় 'গঙ্গারামকে পাত্র পেলে...,' শুনে সবাই বেজায় হাততালি দিল। তারপর বাপি আর আমি মিলে গাইলাম ভবানি দয়ানি। একটুও ভুল হয়নি।
ব্যাস এরপর পাড়া স্কুল বাপিদের অফিসের পিকনিক সবজায়গায় আমিই স্টার। একটু অহংকার আসছিল। আচ্ছা হবে না বুঝি? সবাই পাত্তা দেয়। দিদিমনিরা চোখে হারায়। আসলে আমি তখনই খুব পাকা। খেলাধুলো তো করিনা । সব সময় মা কিংবা বাপি। বড়দের গল্প। কত লোক সামনে থাকুক আমার এতটুকু ভয় করে না। চোখ মুখ নেড়ে ঝটপট কিছু শুনিয়ে ফেলি। স্কুল ইন্সপেক্টর ম্যাডামের আমার গান শুনে কি আনন্দ! কত আশীর্বাদ করলেন। বাপিকে যখন মা ঘটনাটা বলছে তখন মায়ের মুখে যেন হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠছে।
বাপি আমাকে নিয়ে কত স্বপ্ন বুনে ফেলল। নিজে বানীচক্র থেকে কিছুদিন গান শিখেছিল। বড় কোনো শিল্পী র কাছে কলকাতায় থেকে শেখার শখ ছিল। আমার মধ্যে সেই প্রতিভা আবিষ্কার করে ওদের আনন্দ ধরে না। নিজেকে উজাড় করে বাপি দিনরাত আমার পেছনে লেগে থাকত।
বলতে ভুলে গেছি আমার স্মৃতি শক্তি খুবই ভালো। ইস্কুলের রেজাল্ট সবসময় ভালো হত। প্রথম তিনজনের মধ্যে স্থান বাঁধা । মা হাই স্কুলের জিয়োগ্রাফী টীচার। বাজে নাম্বার পেলে লোকেই বা কি বলবে?
এমনি আনন্দে দিন কেটে যায়। আমরা পুরী গেলাম কি হইচই! আবার বাবার অফিস কাকুদের সাথে লাভা লোলেগাঁও যাওয়া হল । কি মজা!
নাচ শেখা
-------------
এক বিকেলে বাড়িতে মায়ের এক ইস্কুলের বান্ধবী এসেছে। গোলাপী রিবন বেঁধে আমিও যথারীতি প্রস্তুত । সংযুক্তা মাসি আমার নাচ দেখে মুগ্ধ। তাল, ছন্দ, অভিনয় সব মিলিয়ে ক্লিন বোল্ড। মাসি পরের দিন আমাকে জোর করে নিজের মামাতো দিদির কাছে নিয়ে গেল।
এই স্নিগ্ধামাসি.. না না দিদি , আমার নাচের গুরু হয়ে গেলেন। এ ভবিতব্য। লেখা ছিল কপালে। নাহলে এত বছর পর হঠাৎ কলকাতার সল্টলেকে থাকা সংযুক্তা করের সাথে মায়ের কিভাবে দেখা হল? আর মাসিই বা এত উৎসাহ দেখিয়ে আমাদের বাড়ি কেন আসে? স্নিগ্ধা দেব বিখ্যাত বিখ্যাত নৃত্যাচার্যদের কাছে নাচ শিখেছেন। মণিপুরী ও কত্থক দুটোতেই পারদর্শী। আমার তো গায়িকা হবার কথা ছিল । কিন্তু আমার বড় বড় চোখ মেলে 'প্রাণ চায় চক্ষু না চায়' দেখেই মাসির দিদি আমাকে বুকে টেনে নিলেন। বাবাকে আশ্বস্ত করলেন। তবলায় বসে থাকা বয়স্ক ভদ্রলোক, যিনি পরে মৃনাল জেঠু হয়ে গেলেন, বাপিকে বোঝালেন
-দিদির আমার জহুরীর চোখ। যদি বলছেন নাচ হবে তাহলে ওর মধ্যে পদার্থ আছে।
পরের রবিবার থেকে ক্লাস আরম্ভ হল।
তা তা , থৈ থৈ। তা তা তা থৈ থৈ থৈ। এঃ খুবই সহজ। আসলে সবাই পাঁচ বছরে শুরু করে আমি তো অলরেডি ক্লাস ফাইভ। বাপি বলল দেখুক না কিছুদিন।বিদ্যা কখনো ফেলা যায় না। ঝটপট শিখে ফেলতে লাগলাম। কঠিন কঠিন বোল তুলতে কোনো কষ্ট নেই। তিনতাল এর বোল মেলানো বুঝতে মাস দুয়েক লাগল। একবার দুগুন, তিনগুন,চৌগুন বুঝে গেলাম, তারপর তো সবই সহজ। বিলম্বিত লয়ে আমার ঠহরাও দেখেই স্নিগ্ধা মাসি আর মৃনাল জেঠু বললেন -এ মেয়ে প্রডিজি। ডিকশনারি তে প্রডিজি মানে দেওয়া আছে জিনিয়াস, অর্থাৎ আমি ওদের থেকে আলাদা, শ্রেষ্ঠ । আমি সত্যিই অদ্বিতীয়া। সেই দিন থেকেই আমি জানি ছোট খাট কোন ব্যাপার আমাকে ছোঁবে না। কারোর কোনো কথাতে থাকি না। কিন্তু লোকে যেন অহংকারী না ভাবে সেটা সযত্নে মাথায় রাখি। বাপির ভীষণ সুনাম। আমার ব্যবহারে সে নামে যেন দাগ না লাগে।
পয়লা বৈশাখের আগ দিয়ে গাড়ি করে কলকাতা চললাম প্রমিতাদি, শিঞ্জিনীদি আর আমি। বাপি অফিস থেকে ছুটি নেবে বলল কিন্তু গাড়ি তে জায়গা হবে না বলে শেষ অব্দি এল না। ওদের মা দের মুখ একেবারে হাঁড়ি। মা আর আমি টাটা সুমোতে সামনে বসেছি। একটু চাপাচাপি তা হোক। অরবিন্দ ভবনে কম্পিটিশন আছে। জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতা তাও আবার নাচে! মা খুব নার্ভাস।গান হলেও একটা কথা ছিল। মাত্র সাত মাস শিখছি তাতেই দিদি আমাকে যত্ন করে ছেড়ছাড় শেখালেন।
রাধা পুকুরে জল ভরতে এসেছে কৃষ্ণ হাঁড়ি ভেঙে দেবে। রাধা কে? কৃষ্ণের সাথে কি সম্পর্ক? ওরা অভিনয় করে ফোটাতেই পারে না তাতে আমি কি করব? ঐ বয়সেই আমি বুঝি প্রেম,মান অভিমান। কলশী ভেঙে জল পড়লে রাধা কে রাগ দেখাতে হবে কিন্তু তার মনে মনে খুশি খুশি ভাব হবে। প্রমিতাদিদের দিদি এসব শেখান নি । আর মাত্র এই কদিনেই উনি এই জটিলতায় আমাকে ঢোকালেন। আমি বুঝি ওদের রাগ হওয়া খুব স্বাভাবিক। তবে আমার তো ঈশ্বরদত্ত ক্ষমতা। এসব তুচ্ছাতিতুচ্ছ কথা গায়ে মাখলে চলে ? আমার নিজের নাচের ড্রেস পর্যন্ত নেই। দিদিই জোগাড় করে দিয়েছেন। মনে মনে খুব হাসতে থাকি।
মা যত্ন করে আমার চোখটা এঁকে দিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে আমি নিজেই মুগ্ধ। লাল ঘাগরা, সোনালী লাল ওড়না, কানে গলায় মুক্তোর মালা আর কাজল কালো চোখ। মৃগনয়নী বোধহয় একেই বলে। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেল। মার শাড়ি চুল বাঁধা টিপ পরা সবই অন্য রকম। মায়ের সাজপোশাকে একটা নিজস্বতা আছে। আর আমার সাজও ওদের থেকে একদম আলাদা। একা নাচ করতে জীবনে প্রথম মঞ্চে ওঠা। দিদি মাথায় হাত রেখে গজদন্ত দেখিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। ভরসা দিলেন।
আমার আগের মেয়েটির দুধসাদা পোশাক। কি সুন্দর বাঁই-বাঁই করে ঘুরছে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। মুদ্রা, অঙ্গ পায়ের কাজ খুব ক্লিন। স্টেজ জুড়ে যেন ছবি। নাম বলল নন্দিনী। এরই পুরস্কার পাওয়ার কথা। আমাকে কিছু একটা করতে হবে যা এর চেয়ে ভালো। প্রমিতাদি সমানে মেয়েটার নিন্দে করে যাচ্ছে। আমি শুধু দেখছি আমাকে কোন জায়গায় আরো ভালো করতে হবে। এর পর আমার নাম, টেপ বেজে উঠতেই মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে এগোলাম। ভয়ডর আমার কোনো কালে নেই। যেটুকু জানি উজাড় করে দিলাম। আমি না প্রডিজি? আমাকে আমার জিনিয়াস হবার মর্যাদা টুকু রাখতেই হবে। আমার মিষ্টি গানের গলা। বোল-পড়ন্ত পড়ার পর লোকে হাততালি দিল। বুঝতে পারলাম হচ্ছে। ম্যাজিকটা কাজ করছে। রাধার অভিনয় করতে গিয়ে পাড়ার পুকুরের পাড়ে কাদায় পা আটকানোর মতন করে পা ফেললাম। কৃষ্ণ কে দেখে মা যেভাবে জন্মদিনের দিন বাবার হাতে জুঁই ফুলের মালা দেখে খুশি হয় সেই ভাবে তাকানোর চেষ্টা করলাম।
স্টেজ থেকে নামতেই দিদি জড়িয়ে ধরল।
-ওরে তুই কি করলি! যা শেখাই নি তাও অনায়াসে করতে পারিস। তাঁর আশীর্বাদধন্য তুই। নিজেও জানিস না তোর ভেতরে কি আছে!
আমার বড় হওয়া
------------------------
আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায় বাজায় বাঁশি। এখন মাত্র সিক্সে উঠেছি।কিন্তু মনে প্রানে সুরূপার ভুমিকার জন্য তৈরি। স্কুলে চিত্রাঙ্গদা অভিনয় হবে। একবার গান গাইছি আবার যে অ্যাবসেন্ট তার হয়ে প্রক্সি দিচ্ছি। এই অর্জুন, এই কুরূপা, এই সুরূপা তো এই সখী। বাংলা বিভাগের শিখাদি নাচ আর অভিনয় দেখাচ্ছেন। কেবল বয়সে ছোটো বলে আমায় নিলেন না। বললেন- বড় পাকা মেয়ে।
আমি মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ভাবলাম বড়দের মনেও হিংসা থাকে। যাক না আমার তো এই ফাঁকে গানগুলো তোলা হয়ে গেল।
অরবিন্দ ভবনে সেবার পুরস্কার পাইনি ঠিকই কিন্তু ইন্দিরা ভবনে শ্রীকমল সিংহের স্মৃতিতে স্কলারশিপ পেলাম। পর পর পাঁচ বছর। শুধু কল্যাণী কেন কলকাতারও প্রত্যেকটি প্রতিযোগিতার পুরস্কার আমার কাছে। কিংবদন্তী শিল্পী নৃত্যাচার্যদের আশীর্বাদ স্নেহ। দিদির চোখের মনি। এখন সব ছাত্রীরাও আমাকে মেনে নিয়েছে । ওদের কোনো উপায় নেই। জিনিয়াসের সাথে প্রতিযোগিতায় ওরা পারবে কেন? সেভেনেই রাষ্ট্রীয় স্কলারশিপ। আবার নাইনে উঠেই দিল্লি যাওয়ার সুযোগ এল। সেখানেও কথক কেন্দ্রে জয়জয়কার। রেজাল্ট যথারীতি ভালোই হচ্ছে। মা ইচ্ছে করেই আমার ক্লাসকে পড়ায় না। টেনে চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট। সাইন্স নিয়ে এগারো ক্লাসে ভর্তি হলাম গেল বছর।
আর গেল বছরই আমাদের এখানে এল ঐন্দ্রিলা সাহা। দেখতে ভালো আবার তৈয়ারিও খুবই ভাল, ওর মা প্রাথমিক ভাবে শেখাতেন তার পর খোদ নৃত্যাচার্য রাজাজীর সাক্ষাত শিষ্যর কাছে তালিম নিত। আমার ক্লাসে পড়ে তবে ইংরেজি মিডিয়াম সেন্ট অ্যাগনেস এ। দিদি ওকে দেখেই খুব পছন্দ করে ফেললেন। তা হবেই তো- পহলে দরশনধারী পাছে গুন বিচারী।
হিংসুটে ভাবলেন নাকি? আরে ছোঃ আমি না জিনিয়াস। এই সব ছোটখাটো ব্যাপার আমাকে ঠিক নাড়া দিতে পারে না।
তবে খেলাম নাড়া।আজ পর্যন্ত সেভাবে বইয়ের পাতায় মন দিই নি। রোজই নাচ গান রেওয়াজ লেগেই থাকে। এত পড়ার চাপ যে একদিন ক্লাস না গেলে সব গোলমাল হয়ে যায়। প্রথম পরীক্ষার ফল খুব খারাপ হল। এর মাঝে আবার দিন সাতেকের জন্য দিল্লি যাওয়া হল।ক্লাস যা মিস হয় শেষ করার সময় নেই। পড়া যেন মাথার ওপরে বিরাট বোঝা । কলকাতার সাংস্কৃতিক পরিসর, ইয়ুথ ফেস্টিভ্যাল গুলোতেই আঠেরোর উর্দ্ধে নাম দেওয়া যায়। আমরা দুজনেই নাম দিয়েছি। স্কুল,টিউশান, রেওয়াজ আবার মাঝে মধ্যে বাপির সাথে গানে বসা আমায় যেন ঘড়ির সাথে পাল্লা দিতে হচ্ছে। ঐন্দ্রিলা কমার্স নিয়েছে। আর আমি অঙ্ক, বায়োলজি, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। তবে আমি শেষ পর্যন্ত পারবই । আমি যে মেধাবী। একটু সময় দিলেই হয়ে যাবে। আসলে সময়টাই যে হচ্ছে না।
মা আমাকে সাহায্য করতে পারছে না, এটাও একটা সমস্যা। বাপির অঙ্ক ছিল তবে ব্যাঙ্কের চাকরি করতে গিয়ে সব ভুলে গেছে। অত ভাবি না। ও আমি ঠিক উতরে দেব। ইউথ ফেস্টিভ্যাল সেই নন্দিনী আর তার মায়ের সাথে দেখা হল। নন্দিনী এখনো সাদা জামা পরে। ওটা ওর সিগনেচার কস্টিউম । ওর মা প্রেসিডেন্সিতে ভর্তির গল্প করল। মা সব খুটিনাটি জেনে নিল। আমার এবারের নতুন খেলা প্রেসিডেন্সি কলেজ।
হল না মা। বাপি আমি যে পারছি না। ঐন্দ্রিলা এগিয়ে যাচ্ছে যে। এবার সব জায়গায় ওই প্রথম। তবলার মিহিরদা রেওয়াজের সময় বলে
-কি হলো?
স্কুলে বড়দি বলেন -কি হলো তোমার?
টিউশানের মলয় স্যার বলেন -এত কিছু একসাথে কি হয় মা? ক্লাসে পম্পা, রুবিনা যারা সাধারণ ছিল সবাই ভালো করছে। আর আমি অদ্বিতীয়া রায় পারছি না।
কোনোদিন তাকাই নি যার দিকে সেই কালো চশমা পড়া ছেলেটা কাছে এসে ঐন্দ্রিলার কথাই জানতে চাইল। আমি নাকি আকাশের তারা! সবার নাগালের বাইরে। এককথায় সুরূপা আমি কিভাবে যেন কুরূপা হয়ে গেলাম। কেন কেন কেন?
মা তুমি বললে -পড় মিমি পড়। তুই পারবি। পারতেই হবে।
বাপি তুমি বললে - যার হয় তার সব কিছুই হয় আর যে পারে না সে কিছুই পারে না। দেখিস না মালবিকাদি তো ডাক্তার আবার বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী।
বাপি প্রডিজি মানে কিন্তু অলরাউন্ডার নয়! হয়তো তাও পারতাম, কিন্তু দিনে যে মোটে চব্বিশটি ঘন্টা!
মা তুমি তো একবার বলতে -পারছিস না চল মিমি অন্য কিছু করি। বাপি তোমরা সাধারণ মেয়ে কেন চাও নি গো? এই তো একফাঁকে ছুট্টে দেখে এলাম আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ঐন্দ্রিলা আমার জন্য কেঁদে কেঁদে আকুল।ওর বাপি বলছে ওকে নাচ করতে হবে না। ও মায়ের পাশে ঘুমোয় ! ওর মাথায় হাত বোলানোর দাদু, চুল আঁচড়ে দেয় দিদা।
আর আমি সব সময় টিপটপ, পিকচার পারফেক্ট। তোমরা কেঁদে বললে আমি স্বার্থপর নিষ্ঠুর! কি স্বার্থ আমার? আমি তো ছিলাম তোমাদের ট্রফি। সব সময় সর্বত্র ডিসপ্লে করেছ। আমার কি ছেলেবেলা ছিল? পার্ক ,বাগান, নিজের মত চুপ করে থাকা?
মা গো বন্ধু কোথায় আমার? সমবয়সী? কিংবা অসমবয়সী? মেয়ে বা ছেলে? না পারা, হেরে যাবার ক্ষোভ বুকের ভেতর গুমরেছে কেন ছিলে না সাথে তখন?
আসলে তো আমি অনেক আগেই বুঝেছি হচ্ছে না, কিন্তু আমি যে অদ্বিতীয়া।অনন্যা হয়েই থাকতে হবে আমায়। দ্বিতীয় হবার উপায় রাখো নি গো তোমরা।তাই নেই হয়েই থাকবে তোমাদের অদ্বিতীয়া। জন্মদিনে কেনা আমার প্রিয় টমেটো রেড চুড়িদার কামিজটাই পড়লাম। দামী আইলাইনার যেটা দিল্লিতে মল থেকে কিনেছিলাম সেটাই লাগালাম যত্ন করে। আছে ঐন্দ্রিলার আমার মতন চোখ ? অতল দিঘির মতন? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জীবনের শ্রেষ্ঠ পারফেক্ট পারফরম্যান্স দিলাম। সোলহ শৃঙ্গার তারপর বিন্দাদিন মহারাজের লেখা আর দিদির কাছে শেখা প্রথম আর প্রিয়তম ঠুমরি ...সব বন ঠন আয়ে শ্যাম প্যারি রে।
জানো বাপি, ফ্যানের সাথে ওড়নাটা বাঁধতে কেমন যেন লাগছিল। তারপর তো শুধু পা দিয়ে চেয়ার টা ঠেলা।